১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন : Dr Abdul Musref Khan

Bengali Darpan
0

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সমর্থ্য না হওয়ায় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শ্রমিক কৃষকেরাও এই আন্দোলনে যোগদান করায় আন্দোলন প্রবল রূপ ধারণ করে। ভারতবাসীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ প্রশমিত করার জন্য দেশবাসীকে একটি নতুন শাসন সংস্কার উপহার দেওয়ার কথা চিন্তা করে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন গঠিত হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সাইমন কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে ১৯৩০, ১৯৩১ এবং ১৯৩২ এ তিনটি গোল টেবিল বৈঠক আয়োজন করে। সাইমন কমিশনের রিপোর্ট ও তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ও প্রস্তাবলির ভিত্তিতে স্বাধীনতার দিকে যাত্রা এবং নতুন রাষ্ট্রের উদয় ব্রিটিশ সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ মার্চ। এই সকল প্রস্তাব বিচার বিবেচনা করে লর্ড লিনলিথগোর সভাপতিত্বে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উভয় সভা থেকে কিছু মনোনীত সদস্য নিয়ে একটি যৌথ সিলেক্ট কমিটি গঠিত হয় নতুন শাসন সংস্কার প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে। এই কমিটিতে ব্রিটিশ ভারত থেকে ২১ জন এবং দেশীয় রাজনীয় শাসিত অঞ্চলগুলি থেকে ৭ জন ভারতীয় প্রতিনিধি করে দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করে। ভারত সচিব স্যার স্যামুয়েল হোর হাউস অফ কমন্স এ বিলটি উত্থাপন করলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। রক্ষণশীল নেতা চার্চিলের আপত্তির ফলে বিলের কিছু অংশ সংশোধন করা হয়। অন্যদিকে ভারতীয়দের ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস না দেওয়ার শ্রমিক নেতা এটলি প্রতিবাদ জানান। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা আগস্ট রাজকীয় সম্মতিলাভ করে বিলটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনটি হল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের সাইমন কমিশন নিয়োগ এর মাধ্যমে যে শাসন সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল তা ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনে পরিপূর্ণতা লাভ করে। প্রশ্ন : ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের শর্ত গুলি উল্লেখ কর। উত্তর : সাইমন কমিশনের সুপারিশ (১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ) এবং প্রথম (১৯৩০), দ্বিতীয় (১৯৩১) এবং তৃতীয় (১৯৩২) গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন পাস হয়। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা।১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুসারে কেন্দ্রে এক ধরনের দ্বৈত শাসন প্রবর্তিত হয়। এই আইনের মাধ্যমে স্থির হয় যে-

১। ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে কেন্দ্রে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা করা হবে। দেশীয় রাজ্যগুলির পক্ষে এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছাধীন ছিল।

২। কেন্দ্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তাতে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজন্যবর্গ এর মনোনীত প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। নিম্নকক্ষ বা কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৭৫ জন এবং এর মধ্যে ১২৫ জন দেশীয় রাজন্যবর্গ কর্তৃক এবং ২৫০ জন ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন। উচ্চকক্ষের সদস্য ছিল ২৬০ জন এবং এর মধ্যে দেশীয় রাজন্যবর্গ মনোনীত করতেন ১০৪ জনকে। এছাড়াও বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল।

৩। মুসলিমদের জন্য সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা এবং তপশিলিদের জন্য পুনা চুক্তি অনুসারে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও শিখ, খ্রিস্টান, ইউরোপীয়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পৃথক

৪। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গভর্নর জেনারেলের অধীনে একটি মন্ত্রী পরিষদের ওপর ন্যস্ত হয়। আইনসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে গভর্নর জেনারেল তার মন্ত্রিপরিষদের সভ্যদের নিয়োগ করবেন এবং মন্ত্রীরা তাদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন। গভর্নর জেনারেল ইচ্ছে করলে মন্ত্রীদের পদচ্যুত করতে পারবেন।

৫। কেন্দ্রীয় শাসনের বিষয়গুলিকে সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। দেশরক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা, পররাষ্ট্র এবং ধর্মসংক্রান্ত বিষয় সম্পূর্ণভাবে গভর্নর জেনারেল ও তার তিন উপদেষ্টার হাতে থাকবে। এ ব্যাপারে ভারতীয় আইনসভার কোন অধিকার ছিল না। এগুলির জন্য গভর্নর জেনারেল সরাসরি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী ছিলেন। হস্তান্তরিত বিষয়গুলির শাসনভার মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে গভর্নর জেনারেলের হাতে ন্যস্ত ছিল।

৬। তিনি ইচ্ছে করলে আইনসভা ও মন্ত্রীদের পরামর্শ উপেক্ষা করতে এবং অন্যান্য বিষয়েও হস্তক্ষেপ করতে পারবেন।

7. কোন আইন রচনার পূর্বে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে গভর্নর জেনারেলের অনুমতি নিতে হবে।

৮। গভর্নর জেনারেল তার কাজের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। 

অন্যদিকে এই আইনের মাধ্যমে-

১। প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হয়।

২। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রাদেশিক গভর্নরের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হবে এবং তার সদস্যরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে মনোনীত হবেন।

৩। কেন্দ্রের মতো প্রদেশগুলিতেও আইনশৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় গভর্নরের অধিকারভুক্ত হয়।

৪। স্থির হয় আইন প্রণয়ন, প্রবর্তন বা নাকচ করার অধিকার গভর্নরের হাতে থাকবে।

৫। মুসলিম সদস্যদের জন্য পৃথক নির্বাচন ও তপশিলি সদস্যদের জন্য পুনা চুক্তি অনুসারে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। ঘোষণা করা হয় যে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা এপ্রিল থেকে এই আইন কার্যকরী হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*