ভারত পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্কার :

Bengali Darpan
0

পৃথিবীজুড়ে ভিন্ন প্রকৃতির প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষ, তাদের সমাজ, ভাষা, রীতিনীতি দেখা যায়। ভারতবর্ষেও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, মানুষের সমাজ, ভাষা, আচার- আচরণের পার্থক্য ও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তাই ভারতকে পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্করণ (epitome of the World) বলা হয়।ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ এই দেশের তিনদিকে সমুদ্র ও একদিকে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা অবস্থিত। উত্তর গােলার্ধে অবস্থিত ভারতের মাঝ বরাবর কর্কটক্রান্তিরেখা (23.1/2° উ.) প্রসারিত হয়েছে। সুউচ্চ পর্বত, সুবিস্তৃত মালভূমি ও সমভূমি ভারতে দেখা যায়। বালি ঢাকা মরুভূমি, বৈচিত্র্যপূর্ণ মৃত্তিকা, বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু, নানারকম স্বাভাবিক উদ্ভিদ যেমন এই দেশে দেখা যায়, তেমনি অনেকরকম খনিজ সম্পদও ভারতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ভারতে বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ বসবাস করে। জীববৈচিত্র্যেও ভারত পৃথিবীতে অগ্রগণ্য। সুতরাং, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মতাে ভারতে প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্য, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের বিভিন্নতা এবং বিবিধ মানবিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদের সমাবেশ ঘটেছে। তাই ভারতকে পৃথিবীর ক্ষুদ্র প্রতিরূপ বলা হয়।

  • ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ভারতবর্ষের ভূপ্রাকৃতিক বিভাগগুলি কী কী?

ভারত পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত একটি দেশ । নিরক্ষরেখার উত্তরে অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধে এবং মূলমধ্যরেখার পূর্বে অর্থাৎ পূর্ব গোলার্ধে অবস্থিত অর্থাৎ ভারত উত্তর-পূর্ব গোলার্ধে অবস্থিত । ভারতের মূল ভূখণ্ড দক্ষিণে ৮°৪' উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ৩৭°৬' উত্তর অক্ষাংশ এবং পশ্চিমে ৬৮°৭' পূর্ব দ্রাঘিমা থেকে পূর্বে ৯৭°২৫' পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত । ভারত দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত । দক্ষিণে মান্নার উপসাগর ও পক প্রণালী ভারতকে শ্রীলঙ্কা থেকে পৃথক করেছে ।

বিস্তৃতি : ভারত উত্তর থেকে দক্ষিণে ৩,২১৪ কিমি. এবং পশ্চিম থেকে পূর্বে ২,৯৯৩ কিমি বিস্তৃত । ভারত রাষ্ট্রের মোট আয়তন ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিমি. । ভারতের স্থলভাগের পরিসীমা ১৫,২০০ কিমি এবং উপকূলভাগের দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিমি.এবং ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন জলভাগের দৈর্ঘ্য উপকূল থেকে ২২ কিমি. পর্যন্ত ।

সীমা : ভারতের উত্তর সীমানা জুড়ে হিমালয় পর্বতমালা অবস্থান করছে । এই সীমায় রয়েছে চিন, নেপাল ও ভুটান রাষ্ট্র । সর্ব উত্তরে ভারত, পাকিস্তান ও চিনের মিলিত সীমারেখাটি হল 'ইন্দিরা কল' । উত্তর-পূর্বে ম্যাকমোহন লাইন তিব্বতীয় চীন ও ভারতীয় ভূখণ্ডের সীমারেখা । উত্তর-পশ্চিমে ভারতীয় কাশ্মীর ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখাটি হল L.O.C বা Line of Control । দেশের পশ্চিম সীমায় রয়েছে পাকিস্তান ও আরব সাগর । ভারত ও পাকিস্তানের ঘোষিত সীমারেখা হল রাডক্লিফ লাইন । দক্ষিণ সীমায় অবস্থান করছে ভারত মহাসাগর, মান্নার উপসাগর ও শ্রীলংকা । দেশের পূর্ব সীমায় রয়েছে বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ ও মায়ানমার রাষ্ট্র ।

ভারতের পশ্চিমতম প্রান্ত হল গুজরাটের কচ্ছ জেলার গুহার মোতি গ্রাম, উত্তরতম প্রান্তটি হল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের পূর্ব কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির ইন্দিরা কল, পূর্বতম প্রান্তটি হল অরুণাচল প্রদেশের আনজাউ জেলার কিবিথু এবং দক্ষিণতম প্রান্তটি হল নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ইন্দিরা পয়েন্ট । 


  • প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের ওপর হিমালয়ের প্রভাব বর্ণনা করো?

ভারতের উত্তরে অবস্থিত সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা ভারতকে এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশ থেকে পৃথক করেছে। এর ফলে মধ্য-এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলি অবাধে ভারতে প্রবেশ করতে পারেনি, ভারত বহিঃশক্রর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। মধ্য-এশিয়ার শুদ্ধ ও শীতল বাতাসও ভারতে প্রবেশ করতে পারে নি হিমালয়ের জন্যই। তাই ভারতের আবহাওয়া হয়েছে নাতিশীতোষ্ণ। আবার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু হিমালয়ে বাধা পেয়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ভারতকে করে তুলেছে শস্যশ্যামলা।হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট হয়েছে সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র – ভারতের তিন প্রধান নদ-নদী। উত্তর-ভারতের গঙ্গা বিধৌত সমভূমিকেও তাই হিমালয়ের দান বলা চলে। হিমালয় বহিঃশত্রুর আক্রমণ রুখলেও, বহিরাগত জাতির আগমনের দ্বার সম্পূর্ণ রুদ্ধ করেনি। হিমালয়ের খাইবার, বোলান, গোমাল, প্রভৃতি গিরিপথ দিয়ে আর্য, ইন্দোগ্রীক, শক, কুষাণ, পরবর্তীকালে পাঠান, মুঘল প্রভৃতি জাতিগুলি ভারতে এসেছে এবং ভারতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আবার ঐ সব গিরিপথ দিয়েই ভারতীয় সভ্যতা, বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে চীন, তিব্বত, মধ্য-এশিয়ায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই বলা যায়, ইতিহাসের ওপর হিমালয়ের প্রভাব অসীম।

প্রশ্ন : সেন রাজা বল্লালসেন সম্পর্কে একটি টীকা লেখ?

উত্তর : বল্লাল সেন : বিজয় সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বল্লাল সেন সিংহাসন আরোহণ করেন। ‘নৈহাটি পট্ট' ও 'বল্লালচরিত' গ্রন্থ থেকে তাঁর রাজ্যকাল সম্পর্কে জানা যায়। অবশ্য বল্লালচরিতের ঐতিহাসিক মূল্য সন্দেহাতীত নয়।

'বল্লালচরিত' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি মগধ ও মিথিলা জয় করেছিলেন। ভাগলপুরের একটি লেখ থেকেও জানা যায় যে, অন্তত মগধের কিয়দংশ তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। তাছাড়া মগধে রাজত্বকারী শেষ পালরাজ গোবিন্দ পাল বল্লাল সেনের রাজত্বকালে রাজ্যহারা হন। সুতরাং এ বিষয়েও তাঁর কিছুটা কৃতিত্ব ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। তা ছাড়া তিনি বর্তমান চব্বিশ পরগনা ও মেদিনীপুর জেলার কিয়দংশ সেন সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হন।

সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও সমাজসংস্কারক হিসেবে বল্লাল সেনের সুখ্যাতি ছিল। তিনি স্বয়ং ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর' নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থ দুটিতে তিনি হিন্দু আচার ও ক্রিয়াকর্মের বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনিই ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের উত্তর: লক্ষণ সেনের রাজত্বকালের শেষ দিকের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল তুর্কি মধ্যে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের নায়ক কুতুবউদ্দীন আইবকের সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মতে, কৌলিন্য-প্রথার প্রবর্তন করে তিনি জাতিভেদ-প্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি করেছিলেন। বাংলা আক্রমণ। মিনহাজ উদ্দিন সিরাজের রচিত তবাকৎ-ই-নাসিরি গ্রন্থে এই ঘটনার অনেকের মতে, রাজনৈতিক প্রয়োজনে তিনি এই প্রথার প্রবর্তন করেন। যাই হোক্, এই বিবরণ পাওয়া যায়। মিনহাজ উদ্দিনের বিবরণ থেকে জানা যায় যে বখতিয়ারের বিহার ঘটনা তাঁর রক্ষণশীল মানসিকতার পরিচয় দেয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন যে, বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক নন। এই প্রথা বল্লাল সেনের প্রায় জয় সম্পূর্ণ হবার পর তিনি যে বাংলা আক্রমণ করবেন। সে বিষয়ে আগেই লক্ষণ সেন রাজ-জ্যোতিষীগণদের দ্বারা জানতে পেরেছিলেন এমনকি তাঁকে দেশত্যাগের পরামর্শও পাঁচ-ছয় শত বৎসর পরে বাংলার কুলপঞ্জির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল। তবে দেন। কিন্তু লক্ষণ সেন দেশ ত্যাগ করেননি। তিনি যখন নবদ্বীপে অবস্থান করছেন। তখন দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, হয়তো বল্লাল সেন ‘আচার, বিনয়, বিদ্যা, বৃত্তি, দান ইত্যাদি গুণের ভিত্তিতে কয়েকটি ব্যক্তি বা পরিবারকে কুলীন মর্যাদা দান করেছিলেন। বখতিয়ার মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে বাংলার রাজধানী নবদ্বীপ নগরে প্রবেশ বল্লাল সেন চালুক্য রাজকন্যা রমাদেবীকে বিবাহ করেছিলেন। তিনি 'অরিরাজ করেন। ঠিক ওই সময় বৃদ্ধ লক্ষণ সেন মধ্যাহ্নভোজনে ব্যস্ত ছিলেন তখন তারা প্রাসাদে । নিঃশঙ্কশংকর' উপাধি নেন। বল্লাল সেন ছিলেন তান্ত্রিক হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষক। আরাকান, ঢুকে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। লক্ষণ সেন নগর আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরে নগ্নপদে প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে পলায়ন করেন এবং নৌকাযোগে বঙ্গ অভিমুখে প্রস্থান। নেপাল, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করেছিলেন। বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। শেষ বয়সে পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি করেন। এইভাবে নদীয়া মুসলিম আক্রমণকারীদের দ্বারা অধিকৃত হয়। গঙ্গাতীরে শাস্ত্রচর্চায় জীবন অতিবাহিত করেন। বল্লাল সেন সম্ভবত ১১৫৮ থেকে ১১৭৯ বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭/১৮ জন সৈন্য নিয়ে নদীয়া আক্রমণ করেছিলেন কিনা। কিংবা লক্ষণ সেন কাপুরুষের মতো প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন কিনা বিষয়টি বিতর্কিত। তাই এই কারণে প্রাচীন কাব্য-সাহিত্যে লক্ষণ সেনের চরিত্র ভীরু, কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। 

প্রশ্ন : পাল-সেন যুগের অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা কর?

উত্তর : অর্থনীতি : প্রাচীনকালের ধারা অনুযায়ী পাল ও সেন যুগে বাংলার অর্থনীতি ভিত্তি ছিল কৃষি-উৎপাদন। অবশ্য শিল্প ও বাণিজ্য থেকেও কিছু অর্থাগম ঘটত। জমি মালিক ছিলেন রাজা। তিনি কৃষকদের জমি বিক্রয় ও দান করতেন। কৃষিজ উৎপাদনের মধ্যে প্রধান ছিল ধান। রামচরিতে উৎকৃষ্ট ধানের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য সেকালের লেখগুলিতে বা সাহিত্যে ধানের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। ধান ছাড় আখ, সুপারি, নারিকেল, সরষে, আম, কাঁঠাল, তুলো প্রভৃতি প্রচুর উৎপাদন হত। বরেন্দ্রভূমিতে তখন উন্নতমানের এলাচ উৎপাদন হত বলে জানা যায়। শিল্প-উৎপাদনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল কার্পাস বস্ত্র। এ ছাড়া কাষ্ঠনির্মিত গোরুর গাড়ি, পালকি, নৌকা ইত্যাদি ছিল অন্যতম শিল্পজাত দ্রব্য। মিনহাজ উদ্দিনের লেখা থেকে জানা যায়, সেযুগে দক্ষ অলংকার শিল্পীরও অস্তিত্ব ছিল। পাল ও সেনযুগে শিল্পীরা সংঘব্দধ ছিল। 'দেওপাড়া লেখ' থেকে ‘শিল্পীসংঘের' (গিল্ড) কথা জানা যায়। সেখানে শূলপাণিকে 'বারেন্দ্র শিল্পীগোষ্ঠীর চূড়ামণি' বলা হয়েছে। শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান নেতা মর্যাদার স্মারক হিসেবে রাজার দান গ্রহণ করতেন। পাল ও সেন যুগে বাংলার বাণিজ্যে অবনতি ছিল লক্ষণীয়। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই বাণিজ্ঞহ্রাসের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তখন বাণিজ্যে আরব বণিকদের আধিপত্যের সূচনা-পর্ব। ইতিপূর্বে তাম্রলিপ্ত বন্দরের যে রমরমা ছিল, এ যুগে তা-ও ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। লক্ষণীয় যে, পাল ও সেন আমলের মুদ্রার খোঁজ পাওয়া যায় না। স্বর্ণমুদ্র ছিল না। রৌপ্যমুদ্রা পালযুগে কিছুটা প্রচলিত থাকলেও সেনযুগে তা আর ছিল না। তখন বিনিময়-মাধ্যম ছিল কড়ি। পাল ও সেন আমলে প্রচলিত প্রধান কর ছিল চার প্রকার, যতা-ভাগ, ভোগ, কর ও হিরণ্য। 'ভাগ' ছিল উৎপন্ন শস্যে রাজার প্রাপ্য এক-ষষ্ঠাংশ। ফুল, ফলমূল ইত্যাদি মাঝে মাঝে রাজাকে দেওয়া হত। একে বলা হত 'ভোগ'। 'কর' বলতে বোঝাত জনগণের আয়ের ওপর নির্ধারিত রাজার প্রাপ্য অর্থ। 'হিরণ্য' শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সন্দেহ আছে। অনুমান করা হয়, রাজা শস্যের পরিবর্তে যে নগদ মুদ্রা নিতেন, তাকেই 'হিরণ্য' বলা হত। সেযুগে কয়েকটি অপ্রধান করও আদায় করা হত। গোচারণভূমি, হাট, খেয়াঘাট প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য কিছু কর প্রদান করতে হত। 'উপরিকর' বলে একটি করের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত আপৎকালে প্রচলিত করের অতিরিক্ত হিসেবে এটি আদায় করা হত। অপরাধীদের কাছ থেকে শাস্তি হিসাবেও কিছু অর্থ রাজকোষে জমা পড়ত।

পাল ও সেন আমলের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ার ফলে তৎকালীন সভ্যতা ছিল প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রামগুলি গড়ে উঠেছিল প্রধানত যেখানে জলের সুবিধা বেশি। তবে আকারে ও লোকসংখ্যার বিচারে গ্রামগুলির মধ্যে বিভিন্নতা ছিল। পাল ও সেনযুগ গ্রামপ্রধান হলেও তখন নগরের অস্তিত্বও ছিল। তাম্রলিপ্ত, কোষীবর্ষ, রামাবতী, লক্ষ্মণগড়, দণ্ডভুক্তি, কর্ণসুবর্ণ প্রভৃতি ছিল সেকালের কয়েকটি সমৃদ্ধ নগর। নগরগুলি ব্যবসাবাণিজ্য, তীর্থস্থান ও শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতির অধিকারী ছিল। পাল ও সেন যুগে ধনবণ্টন-বৈষম্য ও তজ্জনিত সামাজিক অসাম্য ছিল। একদিকে ছিল বিত্তহীন কৃষক ও কারিগর শ্রেণি; অন্যদিকে ছিল সমৃদ্ধ বণিক, প্রতাপশালী সামন্তশ্রেণি ও উচ্চপদস্থ রাজপুরুষবৃন্দ।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের ইতিহাসে সেন বংশের কৃতিত্ব আলোচনা কর। অথবা, সেন বংশের শাসনাধীনকালে বাংলার ইতিহাস লেখ?

উত্তর : ভূমিকা : পালবংশের অবক্ষয়ের যুগে বাংলার রাজনৈতিক জীবনধারায় সেনবংশের উত্থান ঘটে। এই সেনবংশের রাজাদের আবার বংশ পরিচয়, আদি বাসস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু পরস্পর বিরোধী উক্তি ও মতভেদও রয়েছে। তবে যাইহোক, আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, সেনরাজাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন দাক্ষিণাত্যের কর্নাটক অঞ্চলের অধিবাসী। এই সেন বংশীয়রা প্রথম স্তরে তাঁরা পাল রাজাদের অধীনে সামস্ত হিসাবে কাজ করতেন এবং পরে পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামন্ত সেন ও তাঁর পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ় অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা করেন। পালরাজা রামপালের অবর্তমানেই হেমন্ত সেন বাংলায় সেন বংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই হেমন্ত সেন সমগ্র বাংলায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন।

বিজয় সেন (১০৯৫-১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ) : হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয়সেনের আমলেই সেন রাজ্যটি একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তিনিই ছিলেন সেনবংশের প্রথম স্বাধীন রাজা। রামপালের মৃত্যুর পর পালবংশের দুর্বলতার সুযোগে তিনি প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশে আপন অধিকার বিস্তার করেন। তিনি রাঢ়ের শূরবংশীয় রাজকন্যা বিলাসদেবীকে বিবাহ করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। সভাকবি উমাপতিধরের দেওপাড়া লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ, মগধ প্রভৃতি রাজাদের পরাজিত করেন। এছাড়াও তিনি মিথিলা ও পূর্ববঙ্গের যাদববংশীয় রাজাদেরও পরাজিত করে। এর ফলেই তাঁর আমলে ক্ষুদ্র সেনরাজ্য একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তাঁর সাম্রাজ্য পূর্বে ব্রহ্মপুত্র থেকে দক্ষিণে কলিঙ্গ এবং পশ্চিমে কোশী গণ্ডক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর ৬০ বছর ব্যাপী রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে শান্তি ও স্থিতির যুগ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে তিনি কঠোর শাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনরায় অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করে বাংলায় এক নতুন গৌরবময় যুগের সূচনা করেন। তাই তিনিই ছিলেন সেন সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।

বল্লালসেন (১১৫৮-১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ) : বিজয়সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বল্লাল সেন ১১৫৮ খ্রিঃ বাংলার সিংহাসনে বসেন। বল্লালসেনের রাজত্বকাল সম্পর্কে জানার উপাদানগুলি হল—নৈহাটি তাম্রপট, বল্লালসেন রচিত অদ্ভুতসাগর ও দানসাগর। এছাড়া রয়েছে আনন্দভট্ট রচিত বল্লালচরিত গ্রন্থ। তিনি চালুক্য রাজকন্যা রমাদেবীকে বিবাহ করে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। তিনি শেষ পালরাজা গোবিন্দপালকে পরাজিত করে গৌড় দখল করেন। বঙ্গাধিপতি ভোজবর্মাকে পরাজিত করে বঙ্গ জয় করেন। 'বল্লালচরিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে তিনি মগধ ও মিথিলা জয় করেন তাই তাঁর রাজ্যসীমা পশ্চিমে মগব ও মিথিলা থেকে পূর্বে বঙ্গ এবং উত্তরে দিনাজপুর রংপুর ও বগুড়া থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি আবার তাঁর সাম্রাজ্যকে বঙ্গ, বরেন্দ্রভূমি, রাঢ়, বাগড়ী ও মিথিলা এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন।

বল্লালসেন ছিলেন মূলত একজন সমাজ সংস্কারক ও ধর্মসংস্কারক। তিনি ঘোরতর রক্ষণশীল ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হিন্দু সমাজকে নতুন করে সংগঠনের উদ্দেশ্যে তিনি নাকি বাঙালি, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। তিনি হিন্দু আচার-আচরণ পদ্ধতির উপর দুটি গ্রন্থও রচনা করেন। যেমন—দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর এই গ্রন্থদুটি তাঁকে বিশেষভাবে যশস্বী করে তোলে। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে তাঁর প্রবর্তিত 'কৌলিন্য প্রথা'র ফলেই বাঙালি সমাজে জাতপাত ও শ্রেণিবৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং এই ঘটনা তাঁর রক্ষণশীল মানসিকতার পরিচয় বহন করে। যাইহোক শেষ বয়সে পুত্র লক্ষণসেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি গঙ্গাতীরে শাস্ত্রচর্চায় জীবন অতিবাহিত করেন।

লক্ষণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) : বল্লালসেনের পর তাঁর পুত্র লক্ষণসেন ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ষাট বছর বয়সে বাংলার সিংহাসন আরোহণ করেন। কয়েকটি তাম্রশাসন ছাড়া মিনহাজ-উদ্দীন রচিত 'তাবাকই-নাসিরি গ্রন্থটি থেকেই লক্ষণসেনের রাজত্বকালের বিবরণ পাওয়া যায়। পিতার ন্যায় লক্ষণসেনও সুদক্ষ যোদ্ধার পরিচয় দেন। তাঁর গৌড়দেশ বিজয় ছিল সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের। তাই তিনি তাঁর নিজের নামানুসারে গৌড়ের নামকরণ করেন লক্ষণাবতী। এছাড়াও তিনি কামরূপ, কাশী ও কলিঙ্গ জয় করেন। আবার কথিত আছে পুরী, বারাণসী ও প্রয়াগে তিনি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেন। এছাড়াও অরি-রাজ-মর্দন-শঙ্কর ও পরম বৈষ্ণব উপাধি নেন।

লক্ষণ সেনের শেষ জীবন ছিল খুবই শোচনীয়। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে মাত্র ১৮ জন সৈন্য নিয়ে বাংলায় নদীয়া আক্রমণ করেন। বখতিয়ারের অতর্কিত আক্রমণে সম্রাট লক্ষণসেন পরাজয় স্বীকার করে নৌকাযোগে রাজধানী ত্যাগ করেন। তবে বিনা যুদ্ধে তিনি পলায়ন করেন এমন বক্তব্য অনেক ঐতিহাসিক গ্রহণ করেননি। যাইহোক, মুসলমান আক্রমণের সম্মুখে পশ্চাদপসরণ করার হীনতা লক্ষণসেনের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করলেও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি একজন কৃতী রাজা ও শাসক ছিলেন। তাছাড়া লক্ষণ সেন ছিলেন একজন পরম বিদ্যোৎসাহী সম্রাট। তাঁর রাজত্বকালে জয়দেব, ধোয়ী, হলায়ুধ, উপমাপতিধর বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির প্রতিভায় তাঁর রাজত্বকাল সাহিত্য ও বিবিধ ধর্মশাস্ত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

মূল্যায়ন : পরিশেষে বলা যায় যে, সেন বংশ অল্পকাল বাংলা শাসন করলেও, নানাদিক থেকে এই শাসনকাল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেন রাজারা গোঁড়া হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার ফলে বাংলায় এই ধর্মেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই মুসলমান আক্রমণ হওয়া সত্ত্বেও যে হিন্দু সংস্কৃতি বেঁচে ছিল তার পিছনে নেহাত সেনদের অবদান কম ছিল না। তাঁরা হিন্দু সংস্কৃতিকে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন।

প্রশ্ন : পাল ও সেন যুগের বাংলার অর্থনীতির বিবরণ দাও?

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন কালের মতোই পাল ও সেন আমলের বাংলার অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি উৎপাদন। তবে এর পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যেরও বিশেষ ভূমিক ছিল। এখানে উৎপন্ন ফসলের মধ্যে প্রধান ছিল ধান, কিন্তু সেই ধানেরই উল্লেখ পাল-সেন যুগের লেখতে ও সাহিত্যে বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় না। তবে রামচরিতে বরেন্দ্রভূমির উৎকৃষ্ট নানা প্রকার ধানের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেই সময় ধান ছাড়া অন্যান্য উত্প তব্যের মধ্যে ছিল আর, সর্বে, আম, কাঁঠাল, মহুয়া, লবণ, বাঁশ, কাঠ, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি। এছাড়াও বরেন্দ্রভূমিতে উত্তম এলাচের চাষও হত। তাছাড়া নদীবহুল বাংলাদেশে মাছ যে একটি প্রধান সামাজিক বনসম্পদ ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। অন্যদিকে, বন্য প্রাণীর ম্পদের অন্তর্গত ছিল। ঐ সময় বন্যপ্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গরু, বানর, হরিণ, শূকর, ঘোড়া ও উট। তবে ঘোড়া ও উট নিঃসন্দেহে বিদেশাগত ছিল। শিল্পব্যবস্থা : শিল্পস্রাব্যের মধ্যে কার্পাসবদ্ধ ছিল প্রধান। এছাড়াও কার্পাসের চাষ ভিন্ন এখানে গুটিপোকারও চাষ হত। সেই সময় লেখ-র প্রমাণ বিশেষভাবে না থাকলেও অনুমান করা যায় যে, কারুশিল্প তখনও কম ছিল না। ঐতিহাসিক মিনহাজের রচনায় জান যায়, সেই সময়কার ঘরবাড়ি, মন্দির, পালকি, গরুর গাড়ি, নৌকা সবই ছিল কাঠের। তাই বলা যায় যে, কুষ্ঠিশিল্পের সমৃদ্ধিও ছিল। যাইহোক, পাল-সেন যুগের শিল্পীদের আবার গোষ্ঠা ছিল। উদাহরণস্বরূপ বিজয়সেনের দেওপাড়া লেখ-তে শূলপানিকে 'বায়েন শিল্পীগোষ্ঠীর চূড়ামণি' বলা হয়েছে। পাল-সেন যুগের লেখতে নৌবাট, নৌবিতান ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ থেকে মনে করা হয় যে, নৌশিল্পেরও অস্তিত্ব ছিল। আবার হট্টপতি, শৌলিক, তরিশ ইত্যাদি রাজকর্মচারীর উল্লেখ থেকে একটি সমৃদ্ধ অন্তবাণিজ্যের আভাসও

পাওয়া যায়।

বাণিজ্যিক অবস্থা : পাল-সেন আমলে বাংলায় তেমনভাবে বাণিজ্যের প্রতিফলন ঘটেনি। তাই সেই সময় স্বর্ণমুদ্রা তো ছিলই না, বরং রৌপ্য মুদ্রারও যথেষ্টহারে অবনতি ঘটেছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে যখন বাণিজ্যের কর্তৃত্ব আরব বণিকদের হাতে চলে যায় ফলে বাংলাদেশে বাণিজ্যের স্রোতে ভাটা পড়ে। তখন ভারতীয় পণ্যের কাছে পশ্চিমের বাজার বন্ধ হয়ে যায়। তাই পূর্বে যেখানে শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, কুলিক, প্রভৃতির যে প্রাধান্য ছিল, অষ্টম শতাব্দীর পরে আর তা ছিল না। ফলে বঙ্গীয় সমাজ ক্রমশ কৃষি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আর সেই সময় কড়িই ছিল বিনিময় মাধ্যমের প্রধান মুদ্রা-যা বাণিজ্যের অবনতির সাক্ষ্য বহন করে।

রাজস্ব বা কর ব্যবস্থা : পাল সেন যুগের সমাজব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে ভূমিদান ব্যবস্থার স্থান ছিল মুখ্য। আর এই ভূমির মূল অধিকার ছিল রাষ্ট্রের বা রাজার। এই ভূমিব্যবস্থার সাথেই জড়িত ছিল করব্যবস্থা। ওই সময় প্রধানত চার প্রকার কর প্রচলিত ছিল। যেমন— ভাগ কর যেখানে রাজার উৎপন্ন কসলের এক-রষ্ঠাংশ প্রাপ্য ছিল। হিরণ্যকর- যা নগদে দিতে হত। আর ভোগ বলতে যেসব দ্রব্য যেমন ফল, ফুল, কাঠ ইত্যাদি মাঝে মাঝে রাজাকে তাঁর ভোগের জন্য পাঠানো হত। এছাড়াও জনসাধারণকে অন্যান্য করেও দিতে হত। যেমন—খেয়াঘাটের কর, গোচারণভূমি কর, উপরিকর অর্থাৎ অতিরিক্ত কর, আবার অপরাধের শাস্তি হিসেবে অর্থদণ্ডও ছিল রাজস্বের অন্যতম উৎস।

গ্রামীণ ব্যবস্থা : পাল-সেন আমলের অর্থনীতি মূলত গ্রামকেন্দ্রিক ছিল। এই সময়ের লেখাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ গ্রামই কোনো না কোনো নদনদী, খাল, বিল প্রভৃতির তীরে বসবাস করত। গ্রাম-সমাজ কৃষি প্রধান হলেও গ্রামে কাষ্ঠশিল্প, মৃৎশিল্প, বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি শিল্পের শিল্পীরাও বাস করতেন। গ্রাম প্রধান বাংলাদেশে আবার নগরের সংখ্যাও কম ছিল না। যেমন- তাম্রলিপ্ত, রামাবতী, লক্ষণাবতী, সোনপুর, কর্ণসুবর্ণ, প্রভৃতি ছিল সেকালের কয়েকটি সমৃদ্ধ নগর। এই নগরগুলিই আবার ব্যবসা-বাণিজ্য, তীর্থস্থান ও শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিল।

সমাজব্যবস্থা : পাল ও সেন আমলের লেখ এবং সাহিত্য থেকে মনে হয় যে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা যেমন বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত ছিল তেমনি আবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণিতেও বিভক্ত ছিল। যেহেতু কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে ভূমিই ছিল প্রধান সম্পাদ তাই এই সম্পদের অধিকারের ভিত্তিকে অবলম্বন করেই সমাজে শ্রেণিবিভাগ গড়ে উঠেছিল। এই সমাজব্যবস্থার একদিকে ছিলেন প্রতাপ মহাসামন্ত, মহামাগুলিকগণ এবং অন্যদিকে ছিল ভূমিহীন প্রজাগণ।

প্রশ্ন : পালও সেনযুগে বাংলার সাংস্কৃতির পরিচয় দাও?

উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক জাগরণে পাল ও সেন যুগে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতি এক চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। এই সময়কালে বাংলার সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যেমন ভাষা, ধর্ম সাহিত্য। জ্ঞান বিজ্ঞান, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চিত্রকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছিল।

সাহিত্য : পাল পর্বে বাংলা ভাষা পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি চর্চার বাহন ছিল সংস্কৃত ভাষা। এই পর্বে বাঙালির লোকভাষা ছিল মাগধী প্রাকৃতের গৌড়-বঙ্গীয় রূপ যা ক্রমশ প্রাচীন বাংলা ভাষায় বিবর্তিত হচ্ছিল। এই সময়কালে বাংলায় সংস্কৃত সাহিত্যের একটি নিজস্ব রচনারীতি গড়ে উঠেছিল যাকে গৌড়ীয় রীতি বলা হয়। ধীরে ধীরে এই গৌড়ীয় রীতি বাংলাদেশের সীমা অতিক্রম করেছিল। তবে গৌড়ীয় রীতিতে রচিত ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধসাহিত্যগুলি গুণগত ও পরিমাণগত দিক থেকে ছিল নিম্নমানের। পালপর্বে অধ্যাত্ম ও দর্শন চিন্তা বিষয়ে কেবলমাত্র 'ন্যায়-কন্দলী' নামে একটি মাত্র গ্রন্থ পাওয়া গেছে যার লেখক ছিলেন শ্রীধর ভট্ট। তৎকালীন সময়ে সীমাংসা ও ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। তবে পরবর্তীকালে জীমূতবাহন শূলপানি

সহপাঠী প্রকাশনী। প্রভৃতি স্মৃতিকারকদের দ্বারা জিতেন্দ্রিয় ও বালক নামে দুইজন ধর্মশাস্ত্র রচয়িতার নাম পাওয়া যায়। এই সময় পালযুগের প্রখ্যাত কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গৌড় অভিনন্দন ও সন্ধাকর নন্দী। এঁদের রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল 'কাদম্বরী কথাসার ও 'রামচরিত”। এছাড়াও পাল-পর্বে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণরাও তখন সাহিত্য রচনায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন শীলভদ্র, শান্তি রক্ষিত, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান প্রমুখ। এঁরা ভিন্ন তৎকালীন সময়ে অভয়াকর গুপ্ত, দিবাকরচন্দ্র, কুমারচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকরাও ছিলেন।

সেনযুগ : সেন আমলকে একদিক থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ বলা হয়, কারণ সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ও বৈদিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই তাঁদের সময়ে সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ ছিল স্বাভাবিক। তবে ধর্মীয় সাহিত্য ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমনভাবে বিকাশ ঘটতে দেখা যায়নি। পালপর্বে বাঙালি প্রতিভার উন্মেষ নানা দিকে ঘটেছিল। কিন্তু সেন আলে সেই প্রতিভা কেবলমাত্র ধর্মীয় সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেনযুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকার ও তাঁদের রচিত গ্রন্থগুলি হল—ভবদেব ভট্ট রচিত “ভৌতাতিতমতিলক", জীমূতবাহন রচিত 'দায়ভাগ' হলায়ুধ রচিত ব্রাহ্মণসর্বস্ব। এছাড়া রাজা বল্লালসেনের আচারসাগর প্রতিষ্ঠাসাগর, দানসাগর, অদ্ভুতসাগর। আবার সেনযুগের প্রখ্যাত কবি জয়দেবের কাব্য 'গীতগোবিন্দম্ এবং ধোয়ীর 'পবনদূত' ছিল খুব জনপ্রিয়। যাইহোক তৎকালীন সময়ে পাল ও সেনযুগে অনেক কালজয়ী রচনা লেখকদের দ্বারা রচিত হয়েছিল।

চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ : চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে পালপর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নাম হল চক্রপানি দত্ত। তিনি শুশ্রুতের টীকা যথাক্রমে আয়ুর্বেদ দীপিকা ও ভানুমতি লিখেছিলেন। এছাড়াও চিকিৎসা সংগ্রহ, শব্দচন্দ্রিকা ও দ্রব্যগুণসংগ্রহ ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। পাল আমলের শেষ দিকে সুরেশ্বর ও বঙ্গসেন নামে আরও দু'জন শাস্ত্রবিদ পণ্ডিতের নাম পাওয় যায়। সুরেশ্বরের ভেষজ গাছগাছড়া বিষয়ক শব্দপ্রদীপ ও বক্ষায়ুর্বেদ এবং লোহার ভেষজ ব্যবহার বিষয়ক লৌহপদ্ধতি গ্রন্থগুলি ছিল উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে শুশ্রুতপন্থী বঙ্গসেনের গ্রন্থের নাম ছিল চিকিৎসা সারসংগ্রহ।

স্থাপত্য-ভাষ্কর্য ও চিত্রকলা : এই যুগের স্থাপত্য বলতে বোঝায় স্তূপ, বিহার, মন্দিরকে। তবে এগুলির অস্তিত্ব কালের প্রকোপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আছে শুধু সামান কিছু ধ্বংসাবশেষ। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, এই স্তূপগুলি বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে বিহার ও মন্দিরের নিদর্শন হিসেবে এখনো সোমপুর মহাবিহারের কিছু অবশিষ্ট দেখা যায়। বাকি সবই প্রকৃতি ও মানুষের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। পিতা-ধীমান ও পুত্র-বীতপাল। তবে তৎকালীন ভাস্কর্য শিল্পগুলি ছিল একান্তভাবে ধর্মভিত্তিক ও ধনী সম্প্রদায়ের বস্তু—যা দেখে মনে হয় এগুলি প্রকৃত অর্থে লোকশিল্প ছিল না। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মতোই চিত্রশিল্পেও পালযুগের কিছু অবদান ছিল তবে সেগুলি অতীতের ধারা বহন করেছিল মাত্র। চিত্রশিল্পে এ যুগ কোনো নতুনত্ব যোগ করতে পারেনি।

প্রশ্ন : মৌর্যযুগের মহামাত্র' নামক রাজকর্মচারীর শাসনকেন্দ্র কোথায় ছিল? 

উত্তর : পুণ্ড্রনগর।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার প্রশাসনিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মূল বাধা বা অন্তরায় কী ? উত্তর : পর্যাপ্ত তথ্যসূত্রের অভাব।

প্রশ্ন : খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের শুরুতে শাসনব্যবস্থায় রাজাদের উপাধি কী ছিল? উত্তর : চতুর্থ মহারাজা'।

প্রশ্ন : সিংহবর্মা কে ছিলেন?

উত্তর : পুষ্করণের (বাঁকুড়া জেলার পোখর্ণা) অধিপতি।

প্রশ্ন : সিংহবর্মার উপাধি কী ছিল?

উত্তর : মহারাজা।

প্রশ্ন : চন্দ্ৰ বৰ্মা কে ছিলেন?

উত্তর : পুস্করণরাজ সিংহ বর্মার পুত্র।

প্রশ্ন : চন্দ্ৰ বৰ্মা কোথায় শাসন করতেন ?

উত্তর : আর্যাবর্তে।

প্রশ্ন : গুপ্ত সম্রাটগণের উপাধি কী ছিল ?

উত্তর : 'পরমদৈবত পরমভট্টারক- মহারাজাধিরাজ' প্রভৃতি।

প্রশ্ন : খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে বাংলার স্থানীয় শাসক কারা ছিলেন? উত্তর : ধনাদিতা, গোপচন্দ্র ও সমাচারদের এবং জয়নাথ প্রশ্ন : বাংলায় সামন্ত রাজারা কী উপাধি গ্রহণ করতেন? উত্তর : মহারাজা।

প্রশ্ন : পুণ্ড্রবর্ধন বলতে কোন এলাকাকে বোঝাত? উত্তর : পুণ্ড্রবর্ধন বলতে সমগ্র উত্তরবঙ্গাকে বোঝাত প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসনে উপারিক কাদের বলা হত?

উত্তর : 'ভুক্তি' প্রশাসককে উপারিক বা উপারিক মহারাজ” বলা হতো। প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়' কী?

উত্তর : গুপ্ত প্রশাসনে বিষয় ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট। প্রশ্ন : বিষয় প্রশাসকের উপাধি কী ছিল ?

উত্তর : "বিষয়" প্রশাসকের উপাধি ছিল 'কুমারমাতা" এবং "আযুক্তক"। প্রশ্ন : নগর শ্রেষ্ঠী' কাদের বলা হয়?

উত্তর : নগর শ্রেষ্ঠীরা ছিলেন সাধারনত শহরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকার বিশু সংস্থার সভাপতি।

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থার বীথি' কী?

উত্তর : গুপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়-এর পরবর্তী প্রশাসনিক ইউনিট হলো বীথি।

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় বিষয়' এবং 'বীথি'-এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন। 

উত্তর : ধর্মাদিত্যের ফরিদপুর তাম্রশাসনে বিষয়পতি'র অধিকরণ ছাড়াও 'বিষ মহত্তর' (জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি) এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ (পুরোগঃ প্রকৃত্যশ্চ) সমন্বয়ে গঠিত এক পরিষদের উল্লেখ পাওয়া যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে, অতিরিক্ত সদস্যদের নাম ও পদবির পরে 'পুরোগঃ' শব্দের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে, সম্ভবত তাঁরা ছিলেন অধিকরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সাধারণ

উপদেষ্টাদের চেয়েও অনেক বেশি অধিকার ও সুবিধা তাঁরা ভোগ করতেন। গুপ্ত

কর্মচারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। জেলার প্রশাসনে বিভিন্ন উপদেষ্টামণ্ডলীর বর্ণনা তাম্রশাসনে বিষয়াধিকরণে কর্মরত দলিলপত্রাদি সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, প্রশাসনে স্থানীয় জনগণের সংযোগ ছিল এবং স্থানীয় প্রশাসনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হতো।

'বিষয়' বা জেলার পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগ বীথি'র শাসনব্যবস্থা প্রাচীন বাংলার প্রশাসনের অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বীথি' শব্দটির প্রকৃত অর্থ অস্পষ্ট। কখনো কখনো বীথি 'ভুক্তি' বা 'মণ্ডল'-এর উপ-বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিছু সংখ্যক শিলালিপিতে এ প্রশাসনিক ইউনিটের উল্লেখ আছে। সমাচার দেবের গুগ্রাহটি তাম্রশাসনে নব্যবকাশিকায় অবস্থিত সুবর্ণবীথিকে ‘স্বর্ণবাজার' বলা হয়েছে। প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে ‘বীথি'র উল্লেখ মল্লসারুল তাম্রশাসন থেকেও জানা যায়। এই একই লিপিতে কোনো ‘বিষয়’-এর উল্লেখ ছাড়াই বর্ধমানভুক্তির অন্তর্ভুক্ত বকটকবীথির নাম পাওয়া যায়। ১৫৯ গুপ্তাব্দের পাহাড়পুর তাম্রশাসনে বীথির অপর একটি উল্লেখ রয়েছে। সেখানে দক্ষিণাংশক-বীথিকে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। পাহাড়পুর তাম্রশাসনে বীথ্যধিকরণের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও কীভাবে এ অধিকরণ গঠিত হতো তা সঠিকভাবে বলা হয়নি। ভূমি দান-বিক্রয় সংক্রান্ত ব্যাপারে বীথ্যধিকরণের দায়িত্ব ছিল বিষয়াধিকরণের অনুরূপ। মল্লসারুল তাম্রশাসনের সাক্ষ্যে জানা যায় যে, বীথির অধিকরণকে সহায়তা দানের জন্য বিশিষ্ট লোকেদের সমন্বয়ে একটি পরিষদ থাকত। বীথির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে 'মহত্তর', 'অগ্রহঋণ,” ‘খড়গী' (অসি যোদ্ধা) এবং অন্ততপক্ষে একজন 'বহনায়ক' (যানবাহন তত্ত্বাবধায়ক) মিলে এ পরিষদ গঠিত হতো। এরূপ ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, গুপ্ত শাসনামলেও বাংলায় এ ধরনের অধিকরণ ছিল।

প্রশ্ন : পাল শাসকদের প্রশাসনিক কাঠামো সংক্ষেপে আলোচনা করুন?

 উত্তর : পাল বংশের দীর্ঘ শাসনে বাংলায় প্রথমবারের মতো এক শক্তিশালী ও স্থায়ী রাষ্ট্রপ্রশাসন ব্যবস্থা সূচিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, প্রাপ্ত উপাদানসমূহ থেকে পাল প্রশাসন-ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে প্রাপ্ত উপাদানের ভিত্তিতে প্রশাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের এক রূপরেখা প্রণয়ন করা সম্ভব। বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ রয়েছে। 'আবৃত্তি সমূহ বিভিন্ন চতুরকো বাংলায় প্রচলিত গুপ্ত প্রাদেশিক শাসন কাঠামোর ওপরই পাল রাজাদের আমলে নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। পাল শিলালিপিতে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ‘চতুরক’গুলি সম্ভবত বিভিন্ন ‘পাটকে বিভক্ত ছিল। এ বিভাগগুলির যথার্থ প্রকৃতি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যুগেও পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় কর্মচারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল ভূমিদান-লিপিতে প্রশাসনিক বিভাগগুলির দায়িত্বে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র 'যুবরাজ' নামে অভিহিত নিয়োজিত রাজকর্মচারীদের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে বোঝা যায় যে, এ বংশের শাসনামলে হতেন। যুবরাজের দায়-দায়িত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গুপ্তযুগের রাজ্যশাসন ব্যবস্থা দক্ষ ও খুবই বিশদ ছিল। তবে এ সকল রাজকর্মচারীর ক্ষমতা ও মতো এ যুগেও রাজপুত্রকে 'কুমার' নামে অভিহিত করা হতো। 'কুমার' প্রাদেশিক দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান সীমিত। রাজকর্মচারীদের এ সুদীর্ঘ তালিকা থেকে পাল শাসনকর্তার পদের মতো উচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্ব পেতেন। এ পদে থাকাকালে কুমারগণ প্রশাসনযন্ত্রের ব্যাপক পরিধি-সহ বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা রাজার সামরিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।

সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই। এ যুগে পূর্ববর্তী যুগের মতো বিভিন্ন ‘অধিকরণের’ প্রচলন অব্যাহত ছিল কিনা বা থাকলেও তাদের গঠন কেমন ছিল তা জানার কোনো উপায়ই লিপিগুলিতে বা অন্যত্র কোথাও নেই। তবে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে হলেও এ অধিকরণগুলির অব্যাহত ব্যবহারের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

যায়। একটি বিষয় এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, পাল লিপিমালায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর সাম্রাজ্য প্রশাসনে পাল রাজাদের বহুসংখ্যক কর্মচারী ছিলেন যাঁদের প্রধান ছিলেন। বেশ আলোকপাত করা হলেও সেগুলিতে সমসাময়িক প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থা 'মন্ত্রী' বা 'সচিব'। পাল রাজাদের শাসনামলেই সর্বপ্রথম রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁর পদমর্যাদা প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ। দেবপালের বাদল স্তম্ভলিপি থেকে এ পদের ক্ষমতা ও মর্যাদার বিষয়টি জানা যায়। ধর্মপালের রাজত্বকালে গর্গ নামে একজন ব্রাহ্মণের পরিবারের সদস্যদের জন্য বংশানুক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদ সংরক্ষিত ছিল। গর্গের বংশধরগণ (দর্ভপাণি, সোমেশ্বর, কেদারমিশ্র ও গুরবমিশ্র) পরবর্তী একশ বছর প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। তাঁরা সকলেই পাল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সুদৃঢ়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে এরূপ আর এক মন্ত্রী বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। যোগদেব ছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের এবং তাঁর উত্তরাধিকারী বৈদ্যদেব ছিলেন কুমার পালের প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বংশানুক্রমিক নীতি পরবর্তী চন্দ্র ও যাদব রাজবংশের ক্ষেত্রেও প্রচলিত ছিল। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তি থেকে এর প্রমাণ মেলে।

পাল যুগের শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি প্রকৃতপক্ষে সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করতেন। রাজা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজ্যশাসনে ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করতেন। 'রাজস্ব প্রশাসন রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, এ যুগে বিভিন্ন ধরনের রাজস্ব আদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। কৃষিভূমির রাজস্ব আদায় করতেন বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের প্রধানগণ যেমন ‘উপারিক, ‘বিষয়পতি', দাশগ্রামিক' ও ‘গ্রামপতি'। রাজস্বের খাত ছিল 'ভাগ', ‘ভোগ, ‘কর’, ‘হিরণ্য', ও ‘উপারিকর প্রভৃতি। এ সকল করের প্রকৃতি নির্ণয় করা কঠিন। তাম্রশাসনে 'ষষ্ঠাধিকৃত' নামে রাজস্ব কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি কৃষকদের কাছে থেকে রাজস্বের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার প্রাপ্য হিসেবে আদায় করতেন। 'ভোগ' কর আদায়ের দায়িত্বে সম্ভবত নিয়োজিত ছিলেন ‘ভোগপতি’। খেয়া পারাপার ঘাট থেকে সম্ভবত রাষ্ট্রের আয় হতো এবং খেয়াঘাটের মাশুল সংগ্রহ করত 'তরিকা' নামক কর্মচারী। উপশুল্ক ও আবগারি কর আদায় বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ‘শৌল্কিক'। চোর-ডাকাতদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষার জন্য আরোপিত কর আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন

পাল রাজাদের অধীনে অনেক সামন্ত রাজা ছিলেন। পাল তাম্রশাসনে তাদেরকে 'রাজন', 'রাজন্যক', 'রণক', 'সামন্ত' ও 'মহাসামন্ত' ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ সকল পদবির প্রকৃত অর্থ ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা কঠিন। তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, তাঁরা ছিলেন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে এ সামন্ত রাজারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের জন্য রামপালের চোদ্দো জন সামন্তের সহায়তা চাওয়ার ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কখনো কখনো সামন্ত প্রধানদের সাহায্যের ‘চৌরোদ্ধরণিক’। ফৌজদারি অপরাধের জন্য আরোপিত অর্থদণ্ড আদায় বিভাগের ওপর পাল রাজাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হতো।

পূর্ববর্তী যুগের মতো পাল যুগেও বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট যেমন 'ভুক্তি', ‘বিষয়’, 'মণ্ডল'-সহ অন্যান্য ছোটো ছোটো বিভাগের প্রচলন ছিল। পাল যুগের লিপিমালায় বাংলায় পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি, বর্ধমানভুক্তি ও দণ্ডভুক্তি, উত্তর বিহারে তীরভুক্তি, দক্ষিণ বিহারে শ্রীনগরভুক্তি এবং অসমে প্রাগজ্যোতিষভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল লিপিমালা থেকে অনেক বিষয়' ও 'মণ্ডল' এর নামও জানা যায়। এছাড়া 'খণ্ডল', 'আবৃত্তি' ও 'ভাগ' নামে

কর্মকর্তা ছিলেন দিশাপরাধিক'। শিলালিপিতে উল্লিখিত 'মহাক্ষপটলিক' নামীয় রাজস্ব কর্মকর্তা ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ' নামক কর্মচারীর সহযোগিতায় হিসাব বিভাগের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ‘মহাদণ্ডনায়ক' ছিলেন বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। 'মহাপ্রতিহার', 'দণ্ডিক’, ‘দণ্ডিপাশিক' ও 'দণ্ডশক্তি' উপাধিধারী কর্মকর্তারা পুলিশ বিভাগ পরিচালনা করতেন। ‘খোল' সম্ভবত ছিলেন গুপ্তচর বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল ?

উত্তর : বাংলা চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। প্রাচীনকালে বাংলার অধিবাসীদের বেশিরভাগ লোকই গ্রামে বাস করত। তারা সবাই মিলে একসাথে গ্রাম গড়ে তুলত। আর গ্রামের আশপাশের ভূমি চাষ করে সংসার চালাত। যারা চাষ করত বা অন্য কোন প্রকারে জমি ভোগ করত, বিনিময়ে তাদের কতকগুলো নির্দিষ্ট কর দিতে হতো।

প্রধানত তিন প্রকারের ভূমি ছিল। ঘর-বাড়ি তৈরি করে থাকার জন্য উপযুক্ত জমিকে 'বাস্তু', চাষ করা যায় এমন উর্বর জমিকে ‘ক্ষেত্র' এবং উর্বর অথচ পতিত জমিকে বলা হতো 'খিল'। এ তিন প্রকারের ভূমি ছাড়াও অন্যান্য প্রকারের ভূমি ছিল। সেগুলো হল- চারণ ভূমি, হাট-বাজার, অনুর্বর, বনজঙ্গল এবং যানবাহন চলাচলের পথ। মনে করা হয় এ সময় ভূমির মালিক ছিলেন রাজা নিজে। তখনকার দিনে ‘নল' দিলে জমি মাপা হতো। বিভিন্ন এলাকায় নলের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকমের ছিল।

প্রাচীনকাল হতেই বঙ্গদেশ কৃষির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাই এদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষির ওপর নির্ভর করে। ধান ছিল বাংলার প্রধান ফসল। এছাড়া পাট, ইক্ষু, তুলা, নীল, সরবে ও পান চাষের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। ফলবান বৃক্ষের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর, খেজুর ইত্যাদি।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হলেও অতি প্রাচীনকাল হতে এখানে নানা প্রকার শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি হতো। বস্ত্রশিল্পের জন্য বাংলা প্রাচীনকালেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় তৈরি হতো। এ বস্ত্র এত সূক্ষ্ম ছিল যে, ২০ গজ মসলিন একটি নস্যির কৌটায় ভরা যেত। কার্পাস তুলা ও রেশমের তৈরি উন্নতমানের সূক্ষ্ম বস্ত্রের জন্যও বঙ্গ প্রসিদ্ধ ছিল। কার্পাস তুলা ও শনের তৈরি মোটা কাপড়ও তখন প্রস্তুত হতো। জানা যায় যে, বঙ্গদেশে সে সময় টিন পাওয়া যেত।

বঙ্গে কৃষি ও শিল্প দ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল। আবার এগুলোর খুব চাহিদাও ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাই বঙ্গের সঙ্গে প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। বঙ্গের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতি ও রেশমি কাপড়, চিনি, গুড়, লবণ, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা, চাল, নারকেল, সুপারি, ওষুধ তৈরির গাছপালা, নানা প্রকার হিরা, মুক্তা, পানড়বা ইত্যাদি।

শিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যও যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। थन ও জল উভয় পথেই বাণিজ্যের আদান-প্রদান চলত। দেশের ভেতরে বাণিজ্য ছাড়াও সে সময়ে বাংলা বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ উন্নত ছিল। স্থল ও জলপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার পণ্য বিনিময় চলত। এ কারণে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নগর ও বাণিজ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যর উন্নতি সম্পর্কে আলোচনা করুন?

 উত্তর : স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলার অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধি হয়ে আসছে। বাংলায় অসংখ্য নদী-নালা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য উপযোগী সুবিধাজনক যোগাযোগ ব্যবস্থার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। আর বঙ্গোপসাগরের সান্নিধ্য বাংলাকে দিয়েছিল সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুযোগ। এই বাণিজ্যিক ঐতিহ্য সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল।

প্রাচীন বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি সমগ্র উপমহাদেশের প্রাচীন বাণিজ্যের সামগ্রিক পটভূমিতে বুঝতে হবে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রে, বিশেষত অর্থশাস্ত্রে, বার্তা (অর্থাৎ বিবিধ বৃত্তি বিষয়ক যে বিদ্যা)-র তিনটি প্রধান দিক কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য উল্লিখিত হয়েছে। কৃষির তুলনায় ব্যবসা থেকে যে অধিকতর অর্থাগম ঘটে, এর স্বীকৃতি দেখা যায় পালি বৌদ্ধগ্রন্থে (মমি নিকায়)। অঙ্গুত্তর নিকায়েও বলা হয়েছে, বাণিজ্য থেকে প্রভূত ধনলাভ করা সম্ভব।

শস্যের বাণিজ্যিক লেনদেন বিষয়ে বিগত এক দশকে চমকপ্রদ পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য মিলেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষত উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং মেদিনীপুর জেলা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে অনেকগুলি পোড়ামাটির নামমুদ্রা এবং নামমুদ্রার ছাপ। নামমুদ্রাগুলি প্রধানত পাওয়া গেছে দুই প্রধান প্রত্নক্ষেত্র চন্দ্রকেতুগড় (উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) এবং তমলুক (মেদিনীপুর জেলা) ও সন্নিহিত এলাকা থেকে। এই নামমুদ্রাগুলির অধিকাংশই ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী মিশ্রিত লিপিতে উৎকীর্ণ লেখ দেখা যায়। ক্ষুদ্র লিপিগুলি পুরালেখবিদ্যার বিচারে আনুমানিক খ্রিঃপূঃ প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টীয় চার শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল। লেখসংবলিত নামমুদ্রার অনেকগুলিতে দেখা যায় জলযানের প্রতিকৃতি; জলযানের পাটাতনে রাখা পেটিকাও প্রদর্শিত; পেটিকার ভেতরে রয়েছে সশীষ ধানের গুচ্ছ। একটি নামমুদ্রায় উল্লিখিত হয়েছে একজন বণিকের নাম যিনি খাদ্য (সম্ভবত ধান) বিক্রয় করে প্রভূত ধনের অধিকারী হয়েছিলেন। অনুমান করা সঙ্গত যে, খ্রিস্টীয় প্রথম চার শতকে বাংলা তার প্রভূত কৃষিসম্পদের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে; উৎপন্ন ফসলের, বিশেষত ধানের একাংশ সম্ভবত সমুদ্রপথে রপ্তানিও হতো। 

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার মুদ্রা ও বিনিময় প্রথা সম্পর্কে আলোচনা করুন?

 উত্তর : উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় যদিও খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতকে মুদ্রার ব্যবহার নিয়মিত হয়ে যায়, কিন্তু প্রাচীন বাংলায় মুদ্রার অস্তিত্ব আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় • শতকের পূর্বে প্রমাণ করা কঠিন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উত্তরবঙ্গ সম্ভবত মৌর্য শাসনাধীনে আসে। বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র মহাস্থান থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের যে লেখটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে জানা যায়, পুণ্ড্রনগরে (বাংলার প্রাচীনতম নগর, বর্তমান মহাস্থানগড়ে তার ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত) অবস্থিত রাজকোষে 'গন্ডর' ও 'কাকিনী' রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেক পন্ডিতের মতে ‘গণ্ডক' ও 'কাকিনী' দুই প্রকার মুদ্রার নাম, যা তৎকালীন উত্তরবঙ্গে ব্যহৃত হতো। একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসারে চারটি (গন্ডা)-র হিসেবে কড়ির এক প্রকার একককে বোঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে কড়ির ব্যবহার জানা ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক থেকে বাংলায় ধাতব মুদ্রার উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে উৎখনিত প্রত্নক্ষেত্র থেকে। নিম্নলিখিত প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে বহু রৌপ্য নির্মিত 'অঙ্কচিহ্নিত' মুদ্রা: মহাস্থানগড় (বাংলাদেশ), বাণগড় (দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমবঙ্গ), মঙ্গলকোট (বর্ধমান জেলা, পশ্চিমবঙ্গ), চন্দ্রকেতুগড় (উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ); এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলা থেকেও এই জাতীয় প্রাচীন মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে।

এই তালিকায় অবশ্যই যুক্ত হবে বাংলাদেশে ঢাকার নিকটস্থ উয়ারি-বটেশ্বর, যেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে রূপার অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা সম্প্রতি পাওয়া গেছে। বহু স্থানেই রৌপ্যমুদ্রাগুলি পাওয়া গেছে উত্তর ভারতের কৃষ্ণ চিক্কণ মৃৎপাত্রের (Black Polished Ware) সঙ্গে। বাংলায় উৎখনিত নগরের মধ্যে প্রাচীনতম প্রত্নক্ষেত্র মহাস্থানগড় থেকে রৌপ্যনির্মিত ‘অঙ্কচিহ্নিত' মুদ্রাগুলির বাংলায় উপস্থিতির প্রথম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। রৌপ্য মুদ্রাগুলির ওজন ১.৭ গ্রাম থেকে ৩.৪৮ গ্রাম; অবশ্য অধিকাংশ মুদ্রার ওজন ৩.০ গ্রাম থেকে ৩.৪৫ গ্রামের মধ্যে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, মুদ্রাগুলি জারি করা হয়েছিল। ৩.৭৩২ গ্রাম (অর্থাৎ ৫৭.৬ গ্রেণ) বা সুপরিচিত কার্যাপণ তৌলরীতি অনুসারে। কয়েকটি মুদ্রা ওজনে এই তৌলরীতির অর্ধেক; অনুমান করা সঙ্গত যে ওই মুদ্রাগুলি অর্থকাৰাপণ' পর্যায়ভুক্ত।

বাংলায় আবিষ্কৃত কার্ষাপণ মুদ্রাগুলি প্রধানত রৌপ্যনির্মিত; অবশ্য অঙ্কচিহ্নিত তাম্রমুদ্রা ও বিলন (এক প্রকার শঙ্কর ধাতু) মুদ্রাও অজানা ছিল না। একথা ঠিক যে অঙ্কচিহ্নিত তামার ও বিলনের মুদ্রা রৌপ্যমুদ্রার তুলনায় সংখ্যায় কম। তামার তৈরি 'অঙ্কচিহ্নিত' মুদ্রাগুলি পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় (যেমন, চন্দ্রকেতুগড় ও দেউলপোতা), বর্ধমান জেলার (যেমন, মঙ্গলকোট) এবং বাঁকুড়া জেলায় (যেমন, কিহর)। তাম্রমুদ্রাগুলির ওজন ১.৪ গ্রাম থেকে

সহপাঠী প্রকাশনী ৩.৬২ গ্রামের মধ্যে (অর্থাৎ ২২ গ্রেণ থেকে ৫৬ গ্রেণ এর মধ্যে)। সহজেই বোঝা যায় তামার মুদ্রাগুলি তৈরি হয়েছিল কার্ষাপণ রৌপ্য মুদ্রার তৌলরীতি ৮০ রতি বা ১৪৪ গ্রেণ। সেই তৌলরীতির পরিবর্তে রৌপ্য কার্যার্পণ মুদ্রার তৌলরীতিই এক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। মৌর্যশাসন বাংলায় প্রসারিত হওয়ার অভিঘাতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক নাগাদ উত্তরবঙ্গে ও পরে বাংলার অন্যান্য এলাকায় মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়। উৎখনন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে, এই জাতীয় ‘অঙ্কচিহ্নিত' মুদ্রা (বিভিন্ন ধাতুতে নির্মিত) খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের পর আর ব্যবহৃত হয়নি। রৌপ্য নির্মিত অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রাগুলির বিশদ ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাংলার প্রাচীনতম মুদ্রাগুলিতে অন্তত ১৭২ রকম নকশার ছাপ দেওয়া হয়েছিল। রৌপ্য নির্মিত অঙ্কচিহ্নিত কার্যার্পণ মুদ্রা তৈরির রীতি যে তামার এবং বিলনের মুদ্রা নির্মাণের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল সে বিষয়ে সংশয় নেই। তামা ও বিলনের মতো অপেক্ষাকৃত কমদামি ধাতুতে যে অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রাগুলি তৈরি হলো, সেগুলি সম্ভবত দৈনন্দিন ছোটখাটো লেনদেনের পক্ষে উপযোগী ছিল। দূরপাল্লার বড় মাপের বাণিজ্যের জন্য রৌপ্য মুদ্রার প্রাসঙ্গিকতা বোধহয় অধিকতর।

কুষাণ মুদ্রা দক্ষিণ এশিয়ায় রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা ব্যবহারের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। সেই তুলনায় স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার ভারতীয় উপমহাদেশে দেখা দেয় কিছুটা পরবর্তী আমলে। উপমহাদেশে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের কৃতিত্ব কুষাণ সম্রাটদের প্রাপ্য। কুষাণ সম্রাট ভীম কলফিসেসই সম্ভবত ভারতে সর্বপ্রথম স্বর্ণমুদ্রা জারি করেন। তাঁর মুদ্রার মুখ্য দিকে বেদিতে যজ্ঞরত রাজার যে প্রতিকৃতি দেখা যায়, তা বোধ হয় পার্থীয় শাসক গোটার্জেসের স্বর্ণমুদ্রায় উৎকীর্ণ অনুরূপ নকশা দ্বারা প্রভাবিত। পরবর্তী কুষাণ সম্রাটদের মধ্যে, বিশেষ করে কণিষ্ক ও হুবিষ্ক তাঁদের স্বর্ণমুদ্রায় বহু বিচিত্র নকশা ও প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন।

গুপ্ত মুদ্রা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থার পরিচয় পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। তার মূল কারণ তৎকালীন বাংলায় যথেষ্ট সংখ্যক গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার; গুণগত দিক দিয়ে ও কৃৎকৌশলের মানদণ্ডে গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার শ্রেষ্ঠত্ব সুবিদিত। তবে গুপ্ত সম্রাটগণ যে রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা জারি করেছিলেন, সেগুলি প্রাচীন বাংলায় নিতান্তই অপ্রতুল। বাংলা থেকে গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা যেমন পাওয়া গেছে, তেমনই বেশ কয়েকটি গুপ্তকালীন লেখতে (যার অধিকাংশই প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন এলাকা বা উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত) বিভিন্ন মুদ্রানামের উল্লেখ আছে।

গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার নিয়মিত ব্যবহার ও প্রচলন যে প্রাচীন বাংলায় ছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আবিষ্কৃত গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা থেকে। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটগণ যদিও সুবর্ণ তৌলরীতি অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত ভারী স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করিয়েছিলেন, কিন্তু বাংলায় পাওয়া গুপ্তকালীন লেখতে স্বর্ণমুদ্রা কেবলমাত্র "দিনার" নামেই আখ্যাত (অর্থাৎ ভারী মুদ্রাগুলিও লেখতে 'সুবর্ণ' নয়, 'দিনার' বলে অভিহিত)।

গুপ্ত-পরবর্তী মুদ্রা ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত যেসব শাসক গৌড় এবং বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন, তাঁরাও স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা জারি করেছিলেন। এইসব শাসকের নাম প্রধানত লেখমালা থেকে জানা গেলেও মুদ্রাতেও তাঁদের নাম উল্লিখিত। ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্গের তিন স্বাধীন শাসক ছিলেন ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব এবং গোপচন্দ্র। সমাচারদেব দুই প্রকারের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। উভয় মুদ্রাই ১৪৪ গ্রেণ অর্থাৎ সুবর্ণ তৌলরীতি অনুসারে নির্মিত। তবে তাঁর স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ অনেক এবং তাঁর স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার বঙ্গ অথবা বঙ্গ-সমতট এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের (রাজত্বকাল, ৬০০-৬২৫) অব্যবহিত পূর্ববর্তী বঙ্গের তিন স্বাধীন শাসকের মতোই তিনি সুবর্ণ তৌলরীতি অনুসরণে স্বর্ণমুদ্রা প্রস্তুত করেন। কিন্তু এই স্বর্ণমুদ্রার ধাতব বিশুদ্ধি নিম্নমানের। তাঁর স্বর্ণমুদ্রার কোনো কোনোটিতে সোনার পরিমাণ ৪৯-৫২ শতাংশ, ৩৩ শতাংশ, ৩২-৩৬ শতাংশ এবং ১৬-৩৪ শতাংশ। গৌড়ে শশাঙ্কের পর যিনি ক্ষমতায় আসেন সেই জয়নাগ যে স্বর্ণমুদ্রা জারি করেন সেগুলি সুবর্ণ তৌলরীতি আশ্রিত। তাদের ধাতুগত বিশুদ্ধি উন্নততর মানের। অতএব শশাঙ্ক তাঁর রাজত্বের দুই এলাকায় (গৌড়বঙ্গ এবং সমতট) দুই ভিন্নপ্রকারের স্বর্ণমুদ্রা দুই ভিন্ন তৌলরীতি অনুযায়ী নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থার জটিলতম পরিস্থিতি সম্ভবত দেখা যাবে ৭৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের সময়সীমায়। এই পদের মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে প্রচুর বিতর্কও রয়েছে।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে চক্রপানী দত্ত স্মরণীয় কেন?

উত্তর : চক্রপাণি দত্ত (১১শ শতক) আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও সংস্কৃত পণ্ডিত। একাদশ শতকের শেষভাগে বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত ময়ূরেশ্বর গ্রামে লোরবলী কুলীন বংশে তাঁর জন্ম বলে মনে করা হয়। তাঁর পিতা নারারণ দত্ত ছিলেন গৌড়রাজ নয়পালের (১০৪০-৭০ খ্রি:) সমসাময়িক এবং তাঁর রন্ধনশালার অধ্যক্ষ।

চক্রপাণির গুরুর নাম নরদত্ত। তিনি গৌড়রাজের সভাসদ ছিলেন। প্রাচীন চিকিৎসা বিষয়ে চক্রপাণি রচিত তিনিটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো: চিকিৎসাসংগ্রহ, দ্রব্যগুণ ও সর্বসারসহ। প্রথম একটি চরদত্ত নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। এতে চরকন্যান, বৃদ্ধনুশ্রু প্রভৃতি কয়েকটি লুপ্তপ্রায় প্রাচীন আয়ুর্বেদ গ্রন্থের বিশেষ বিশেষ অংশ উদ্ধৃত হয়েছে। চক্রপাণি বিখ্যাত চরকলাহিতার ওপর চরকদীপিকা এবং সুশ্রুতের ওপর ভানুমতী নামক দুখানি পান্ডিত্যপূর্ণ টীকা রচনা করে যথাক্রমে 'চরকচতুরানন' ও 'সুবহান' উপাধি লাভ করেন। চিকিৎসাশাস্ত্র ব্যাতীত চক্রপাণি ব্যাকরণ ও ন্যায়দর্শন সম্পর্কেও গ্রন্থ রচনা করেছেন ব্যাকরণতত্ত্বচন্দ্রিকা তাঁর একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ। গৌতমের ন্যায়সূত্রের ওপর তিনি একটি টাকা রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। শব্দচন্দ্রিকা নামে তাঁর একটি কোষগ্রন্থও আছে।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধধর্মের বিস্তার কীভাবে ঘটে?

উত্তর : প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রাক-গুপ্ত পর্বেই বৌকবর্ষের বিস্তার ঘটে। যদিও 'বোধিসাবধান কক্সলতা গ্রন্থে ও চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণীতে বুদ্ধের বাংলায় ধর্মপ্রচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু এর পেছনে ঐতিহাসিক পাওয়া যায়নি। তবে বিনরপিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দীক্ষাদান প্রসঙ্গে পুন্ডের উল্লেখ রয়েছে তা থেকে ধারণা করা যায় যে অশোকের পূর্বেই বৌদ্ধধর্ম বাংলার কোন কোন জায়গায় প্রচারিত হয়েছিল।

খ্রিঃপূঃ দ্বিতীয় শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে বৌদ্ধধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মহাস্থান শিলালিপি হতে তা প্রমাণিত হয়। গুপ্ত শাসনামলে রাজাদের উদার আনুকূল্যে বৌদ্ধধর্মের সম্প্রসারণ ঘটে। চীনা পরিব্রাজক ইৎ-সিং-এর বিবরণী হতে জানা যায় যে, মহারাজ শ্রীগুপ্ত চীন দেশীয় ভিক্ষুদের জন্য নালন্দা থেকে চল্লিশ যোজন পূর্বে মৃগস্থাপন স্তূপের কাছে একটি চীনা মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ভিক্ষুদের ভরণপোষণের জন্য চব্বিশটি গ্রাম দান করেন। এই স্তূপ উত্তরবঙ্গে অবস্থিত বলে মনে করা হয়। গুপ্ত যুগে বাংলার বৌদ্ধ সম্প্রসারণের প্রমাণ সেই সময়কালের কিছু মূর্তি ও তাম্রশাসনসমূহ হতে পাওয়া যায়। গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন বাংলায় আসেন। তিনি লিখেছেন যে, তখন তাম্রলিপ্তি নগরীতে বাইশটি বৌদ্ধবিহার ছিল। তিনি এখানে দু'বছর অবস্থান করে বৌদ্ধ গ্রন্থ লিখেছিলেন এবং বৌদ্ধ মূর্তির ছবি এঁকেছিলেন। তাঁর বিস্তৃত বর্ণনায় তাম্রলিপ্তির বিশাল বৌদ্ধ সংঘের একটি উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে।

সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে বাংলায় বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক প্রসারের প্রমাণ পাওয়া যায়। শশাঙ্কের পরবর্তীকালীন একশো বছর বাংলার ইতিহাসে এক অন্ধকারময় যুগ। এই সময় বহিঃশত্রুর আক্রমণ, দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা, স্থানে স্থানে ছোটো ছোটো রাজবংশের ক্ষণস্থায়ী রাজত্ব ক্ষমতার লড়াই ও পারস্পরিক হানাহানি, সবল কর্তৃক দুর্বলের উৎপীড়ন প্রভৃতির ফলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ইতিহাসের সর্বগ্রাসী এই নৈরাজ্যের সময়কাল 'মাৎস্যন্যায়' নামে অভিহিত হয়েছে। মাৎস্যন্যায়ের এই অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে গোপাল প্রকৃতিগণের সহায়তায় বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এখান থেকেই পাল বংশের সূত্রপাত ঘটে। পালরাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পালবংশ চারশো বছর বাংলা শাসন করে। একই রাজবংশের এতো দীর্ঘকালের শাসন ইতিহাসে বিরল। এই দীর্ঘ শাসনকালের মধ্যে চড়াই-উৎরাই লক্ষ করা যায় বটে, কিন্তু বিপর্যয়ের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে পাল রাজারা তাঁদের শাসন অব্যহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই দীর্ঘ শাসনে বাংলার কৃতিত্ব অবশ্যই পালযুগের গৌরব। বিস্তৃত সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা, প্রজাবৎসল শাসন নীতি ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বিভিন্ন শিল্পকলার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধন এবং সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চা এসবই পালযুগের কৃতিত্ব ও গৌরব। বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন সাধনার কেন্দ্র হিসেবে এসময় বাংলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো পাল সম্রাট ধর্মপালের সময়ে নির্মিত পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার। এছাড়া বিক্রমশীল বিহার, ওদন্তপুর বিহার, ত্রৈকুটক বিহার, দেবীকোট বিহার, ফুলবাড়ি বিহার ও জগদ্দল বিহার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।



প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার প্রধান বিভাগগুলি কী কী নামে পরিচিত ছিল? 

উত্তর : প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন অংশের নাম বিভিন্ন ছিল যেমন— বঙ্গ, গৌড়, রাঢ় বা সুক্ষ্ম, বঙ্গাল, বরেন্দ্র, পুণ্ড্র, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি।.

প্রশ্ন : বাংলার প্রাচীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুখ্য বৌদ্ধ গ্রন্থ কোন্‌গুলি ? 

উত্তর : বাংলার প্রাচীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ গ্রন্থ হল দ্বীপবংশ, মহাবংশ, এবং আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প।

প্রশ্ন : পুণ্ড্র কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : পুণ্ড্র কথাটির অর্থ হল আঁখ বা চিনি। বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন জনপদ হল পুণ্ড্র।

প্রশ্ন : পুণ্ড্রবর্ধন কী ?

উত্তর : পুণ্ড্রবর্ধন হল প্রাচীন বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন জনপদ।

প্রশ্ন : কারা এই পুণ্ড্রবর্ধন জনপদ গঠন করেছিলেন?

উত্তর : জানা যায় পুণ্ড্র ‘জন’ বা জাতি এই প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন জনপদ গঠন করেছিল। 

প্রশ্ন : পুণ্ড্রদের রাজ্যের রাজধানীর নাম কী ছিল?

উত্তর : পুন্ড্রদের রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল পুণ্ড্রনগর।

প্রশ্ন : পুণ্ড্রনগরের অবস্থান কোথায় ?

উত্তর : বর্তমান বগুড়া শহরের অদূরে করতোয়া নদীর তীরে পুণ্ড্রনগর অবস্থিত। 

প্রশ্ন : পুণ্ড্রনগরের পরবর্তী নাম কী হয়?

উত্তর : পুণ্ড্রনগরের পরবর্তী নাম হয় মহাস্থানগড়।

প্রশ্ন : মহাস্থানগড় বা পুণ্ড্রনগর-এর আবিষ্কার কে কত খ্রিস্টাব্দে করেন? 

উত্তর : এফ. বুকানন হ্যামিল্টন ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি ১৮০৮ সালে মহাস্থানগড়কে সনাক্ত করেন এবং পরিদর্শন করেন।

প্রশ্ন : ‘রাঢ়' কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে, শব্দটির উৎস প্রোটো-অস্ট্রোএশিয়াটিক 'রাঢ়া’ বা ‘রাঢ়ো' শব্দদুটি, যার অর্থ ‘লালমাটির দেশ' বা 'ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার দেশ'।

প্রশ্ন : প্রাচীন তথ্যসূত্রে রাঢ়কে ক'টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে? 

উত্তর : খ্রিস্টীয় নয় ও দশ শতকের শিলালিপি ও সাহিত্যে রাঢ়ের দুটি বিভাগের উল্লেখ আছে, যথা দক্ষিণ রাঢ় ও উত্তর রাঢ়।

প্রশ্ন : রাঢ় বলতে কোন্ অঞ্চলকে বোঝানো হত?

উত্তর : রাঢ় বলতে পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চলকে বোঝানো হত।

প্রশ্ন : রাঢ়ের রাজধানীর নাম কী?

উত্তর : রাঢ়ের প্রধান নগর বা রাজধানী ছিল কোটিবর্ষ।

প্রশ্ন : “সপ্তগ্রাম” বলতে কী বোঝায়?

উত্তর : সপ্তগ্রাম শব্দের অর্থ সাতটি গ্রাম। এগুলো হল বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বাচোরা এবং বলদঘাটি।

প্রশ্ন : গঙ্গারিডাই কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : ‘গঙ্গারিডাই' শব্দের উৎসটিও স্পষ্ট নয়। ঐতিহাসিক ড. অতুল সুর, প্লিনি ও টলেমির মতে এর অর্থ 'গঙ্গার তীরবর্তী রাঢ় অঞ্চল'।

প্রশ্ন : গঙ্গারিডাই-এর রাজধানীর নাম কী ?

উত্তর : গঙ্গারিডাই-এর রাজধানীর নাম ছিল গাঙ্গে' (Gange) নগর।

প্রশ্ন : 'বজ্জভূমি' কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : 'বজ্জভূমি' (আধুনিক বাংলায়: বজ্রের দেশ) ছিল প্রাচীন রাঢ় অঞ্চলের একটি অংশ।

প্রশ্ন : কোটিবর্ষ-এর অপর নাম কী?

উত্তর : কোটিবর্ষ এর অপর নাম দেবকোট।

প্রশ্ন : 'বঙ্গ' কী ?

উত্তর : 'বঙ্গ' বাংলার একটি সুপ্রাচীন জনপদ।

প্রশ্ন : 'বঙ্গ' নামের উল্লেখ সর্বপ্রথম কোথায় পাওয়া যায়?

উত্তর : ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে সর্বপ্রথম মগধের সঙ্গে 'বঙ্গ' নামের একটি

জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রশ্ন : 'রঘুবংশ' কার লেখা?

উত্তর : 'রঘুবংশ' মহাকবি কালিদাসের লেখা।

প্রশ্ন : মিলিন্দপঞহ গ্রন্থটি কার লেখা?

উত্তর : মিলিন্দপঞহ গ্রন্থটি নাগসেন-এর লেখা।

প্রশ্ন : গৌড় কী?

উত্তর : গৌড় হল প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ও ভৌগোলিক অঞ্চল।

প্রশ্ন : 'বৃহৎসংহিতা' কার লেখা?

উত্তর : 'বৃহৎসংহিতা' বরাহমিহির-এর লেখা।

প্রশ্ন : শশাঙ্ক কে ছিলেন?

উত্তর : সপ্তম শতকের আদিপর্বে গৌড়ের প্রথম স্বাধীন সম্রাট ছিলেন শশাঙ্ক। 

প্রশ্ন : শশাঙ্কের সময় গৌড়ের বিস্তার কতদূর পর্যন্ত ঘটেছিল ?

উত্তর : স্বাধীন সম্রাট শশাঙ্কের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গৌড়ের রাজনৈতিক সীমা অর্থাৎ দক্ষিণে উপকূলীয় উড়িষ্যা ও উত্তরে পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।

প্রশ্ন : শশাঙ্কের রাজধানীর নাম কী ছিল ?

উত্তর : কর্ণসুবর্ণ (কানসোনা) ছিল বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্কের (৬০৬-৬৩৭ খ্রি) রাজধানী।

প্রশ্ন : মিনহাজ কে ছিলেন?

উত্তর : মিনহাজ ছিলেন একজন খ্যাতনামা পার্শিয়ান ইতিহাসবিদ।

প্রশ্ন : খঙ্গ শাসকরা কোথায় শাসন করতেন ?

উত্তর : খঙ্গ শাসকরা শাসন করতেন প্রধান বঙ্গ থেকে সমতট অঞ্চল পর্যন্ত।

প্রশ্ন : চন্দ্র শাসকরা কোথায় শাসন করতেন ?

উত্তর : বঙ্গ ও আরাকান অঞ্চলে চন্দ্র শাসকরা শাসন করতেন।

প্রশ্ন : সমতটে কোন্ ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল ? 

উত্তর : সমতটে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল।

প্রশ্ন : চন্দ্র বংশের রাজারা কোন্ ধর্মাবলম্বী ছিলেন?

উত্তর : চন্দ্র বংশের রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

প্রশ্ন : কোন্ সময় খড়্গা বংশের রাজারা শাসন করতেন ?

উত্তর : খঙ্গ বংশ আনুমানিক খ্রিস্টীয় সাত ও আট শতকে প্রাচীন বাংলার বঙ্গ ও সমতট অঞ্চল শাসন করতেন।

প্রশ্ন : উয়ারী বটেশ্বর কী ?

উত্তর : উয়ারী ও বটেশ্বর নামীয় দুটি গ্রাম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

প্রশ্ন : উয়ারী বটেশ্বর কোথায় অবস্থিত ?

উত্তর : উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদীর বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত।

প্রশ্ন : উয়ারী বটেশ্বর কত প্রাচীন?

উত্তর : বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী এটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। 

প্রশ্ন : হরিকেল কী ?

উত্তর : হরিকেল ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত পূর্ববঙ্গের একটি প্রাচীন জনপদ।

প্রশ্ন : হরিকেল জনপদের অবস্থান কোথায় ছিল?

উত্তর : বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, বর্তমান মায়নমারের রাখাইন রাজ্য, বর্তমান বাংলাদেশের ফেনী অঞ্চল, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ও চট্টগ্রাম বিভাগ-এর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন হরিকেল জনপদ। 

প্রশ্ন : সুবর্ণগ্রাম কী ?

উত্তর : সোনারগাঁও স্বর্ণগ্রাম বা সুবর্ণগ্রাম নামে অভিহিত বঙ্গের এক প্রাচীন জনপদ। 

প্রশ্ন : জাতি বা Caste শব্দটির অর্থ কী ?

উত্তর : জাতি বা Caste শব্দটির উৎপত্তি স্প্যানিশ শব্দ Casta থেকে; যার অর্থ হল - জাতি, কুল প্রভৃতি।

প্রশ্ন : Caste শব্দটি প্রথম কারা ব্যবহার করেন?

উত্তর : বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতি তৈরি হয়েছে বলে একে সংকর জাতি বলা হয়।

প্রশ্ন : বাংলা ভাষা আর কী কী নামে পরিচিত?

উত্তর : বাংলা ভাষা বাঙলা, বাঙ্গলা, তথা বাঙ্গালা নামেও পরিচিত।

প্রশ্ন : সপ্তসিন্ধু বলতে কোন্ অঞ্চলকে বুঝায় ?

উত্তর : সপ্তসিন্ধু বলতে সিন্ধু বিতস্তা ইরাবতী চন্দ্রভাগা শত্ৰু বিপাশা এবং সরস্বতী এই সাত নদী বিধৌত অঞ্চলকে বোঝায়।

প্রশ্ন : বাঙালিরা পৃথিবীর কততম জনগোষ্ঠী ?

উত্তর : চীনা এবং আরবদের বাদে বাঙালিরা পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। 

প্রশ্ন : ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী (Indo-Aryan peoples) কারা ?

উত্তর : ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী (Indo-Aryan peoples) হচ্ছে একটি বৈচিত্র্যময়

প্রশ্ন : নিষাদ কাদের বলা হত?

উত্তর : নিষাদ বা বাইদ হানাদার সংগ্রহকারী, অ-আর্য আদিবাসী ভারতীয়রা বনে বাস

প্রশ্ন : প্রাচীন কোন্ গ্রন্থাবলীতে নিষাদদের উল্লেখ পাওয়া যায়? 

উত্তর : রামায়ণ এবং মহাভারত উভয়গ্রন্থেই নিষাদ চরিত্র সহ নিষাদদের অনেক গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়

প্রশ্ন : ব্রাত্য কাদের বলা হত?

উত্তর : ব্রাত্য সম্ভবত বৈদিক ধর্মাচরণের বিরোধী আর্যজাতি।

প্রশ্ন : ব্রাত্যদের প্রধান জীবিকা কী ছিল ?

উত্তর : ব্রাত্যদের প্রধান জীবিকা ছিল পশু পালন।

প্রশ্ন : বাঙালিরা কোন জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ?

উত্তর : বাঙালি জাতি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ একটি ইন্দো আর্য জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভু

প্রশ্ন : জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর কতগুলি প্রধান নরগোষ্ঠী প্রস্তুত

রয়েছে?

উত্তর : জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে।

প্রশ্ন : বৈদিক সমাজ কয়টি বর্ষে বিভক্ত ছিল?

উত্তর : বৈদিক সমাজ চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল। এগুলি হল [i] ব্রায়গ, [1] ক্ষত্রিয়, [iii] বৈশ্য ও [iv] ।

প্রশ্ন : শূদ্র কারা ?

উত্তর : শুভ্র হিন্দুদের চতুর্বর্ণের শেষ বর্ণ। বেদে আছে, প্রজাপতির পাদদ্বয় হতে শূদ্রের উৎপত্তি।

প্রশ্ন : শুদ্রদের কাজ কী ছিল ?

উত্তর : ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণের পরিচর্যা করাই ছিল শূদ্রদের প্রধান কর্তব্য।

প্রশ্ন : কারা কারা শূদ্রদের অন্তর্ভুক্ত?

উত্তর : বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে এদের সংখ্যাই অধিক। কামার, ছুতার, চিত্রকর, বারোই, নাপিত, ডোম, যুগী, কাপালী, তাঁতি, বাগদি, চণ্ডাল প্রভৃতি বৃত্তি ও শ্রমজীবী

প্রশ্ন : বাংলা ভাষা কোন্ ভাষার অন্তর্গত ?

উত্তর : ইন্দো-ইরানী ভাষাসমূহের বিশেষ একটি ভাষা বাংলা ভাষা। 

প্রশ্ন : বৈশ্য কারা ?

উত্তর : বৈশ্য হচ্ছে হিন্দু সমাজকাঠামোর চতুর্বর্ণের মধ্যে তৃতীয় বর্ণ। প্রশ্ন : বৈশ্যদের কর্তব্য কী ছিল?

প্রশ্ন : বল্লালচরিত কত খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়?

উত্তর : পুঁথিটি ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত।আনন্দভট্ট।

প্রশ্ন : বল্লাল চরিত থেকে কী জানা যায় ?

উড়িষ্যায়। ইদানীং ত্রিপুরা জেলাতেও কয়েক ঘর শবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। 

প্রশ্ন : শবরদের জীবিকা কী?

উত্তর : শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। প্রথমদিকে যাযাবর থাকলেও পরবর্তীতে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন তারা।

প্রশ্ন : উত্তম সংকর জাতি কারা?

উত্তর : বৃহদ্ধর্মপুরাণে তাঁতি, গন্ধবণিক, কর্মকার, তৌলিক (পান-সুপারি ব্যবসায়ী), 

উত্তর : আনন্দভট্ট রচিত “বল্লালচরিত” থেকে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কুমার, শাঁখারি, কাঁসারি, পবিত্র যাত্রীদের উত্তম সংকর জাতি বলে চিহ্নিত করেছেন। ধারণা করা যায়।

প্রশ্ন : সৎ শূদ্র কাদের বলা হত?

উত্তর : যাদের নিকট থেকে উচ্চতর জাতের লোকজন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করছে পারত তাদেরকে সৎশূদ্র বলা হত।

প্রশ্ন : অসৎ শূদ্র কারা ?

উত্তর : যাদের সংস্পর্শকে অপবিত্র বলে বিবেচনা করা হত তারা অসৎ শুদ্র নামে পরিচিত ছিল।

প্রশ্ন : স্মৃতিশাস্ত্রে কোন্ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে ?

উত্তর : স্মৃতিশাস্ত্র এতে হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধান সম্পর্কে আলোচন গুরুত্ব পেয়েছে।

প্রশ্ন : পাল আমলে কৈবর্তদের প্রধান ব্যক্তি কে ছিলেন ?

উত্তর : পাল আমলে কৈবর্তদের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন দিব্য। 

প্রশ্ন : চণ্ডালদের কাজ কী ছিল?

উত্তর : চণ্ডালদের প্রধান কাজ ছিল মৃতদেহ সৎকার করা। একটি নিম্নবর্ণের হিন্দু। প্রথাগতভাবে চণ্ডালদের অস্পৃশ্য হিসেবে ধরা হয়।

প্রশ্ন : ডোম কাদেরকে বলা হত?

উত্তর : ডোম (বৃষ্ঠ ক্ষত্রিয়) একপ্রকার হিন্দু তফসিলি জাতিবিশেষ। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের বাঁকুড়া, বীরভূম ইত্যাদি জেলায় প্রচুর সংখ্যায় ডোম জাতির লোকেরা বাস করেন।

প্রশ্ন : ডোম সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রধান কাজ কী ?

উত্তর : ডোম সম্প্রদায়ের মানুষজন ঐতিহ্যগতভাবে ঝুড়ি-নির্মাতা, কৃষক, শ্রমিক জীমূতবাহন প্রাচীন বঙ্গদেশের একজন সুবিখ্যাত ধর্মশাস্ত্র রচয়িতা ছিলেন - ঢ়াকী। ডোম রমণীরা ধাইয়ের কাজ করেন।

প্রশ্ন : 'দায়ভাগ' কে রচনা করেন ?

উত্তর : জীমূতবাহন দায়ভাগ রচনা করেন

প্রশ্ন : মলমাসতত্ত্ব কে রচনা করেন ?

উত্তর : রঘুনন্দন ভট্টাচার্য।

প্রশ্ন : কৈবর্ত কারা ছিলেন?

প্রশ্ন : অসুর কাদেরকে বলা হত ?

উত্তর : অনেকের মতে, “অসুর” অর্থে বৈদিক আর্যপূর্ব অধিবাসী বা 'আলপাইন’ সমতুল্য গোষ্ঠীকেই বোঝায়।

প্রশ্ন : কপালিক কাদের বলা হত?

উত্তর : কাপালিকগণ অসভ্য সম্প্রদায় হিসেবে পরিগণিত হত, জালিয়া কৈবর্ত বা জেলে কৈবর্ত হচ্ছে তপশিলীভুক্ত একটি জাতি আচার-অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রথা অনুসরণ করত। সংস্কৃতায়নের মাধ্যমে হিন্দু বর্ণ বা সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হয়।

প্রশ্ন : কৈবর্তদের প্রধান পেশা কী ছিল ?

উত্তর : সাধারণত কৈবর্তদের গতানুগতিক প্রধান পেশা ছিল মাছ ধরা। 

প্রশ্ন : শবর কথাটির উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে?

উত্তর : শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর' থেকে।

প্রশ্ন : শবর কথাটির অর্থ কী?

উত্তর : স্কাইথিয়ান ভাষায় ‘সগর' শব্দের অর্থ হল কুঠার।

প্রশ্ন : শবরদের বসতিস্থল কোথায়?

উত্তর : শবররা বাস করেন পশ্চিম বাংলা, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর আর

প্রশ্ন : অস্পৃশ্য জাতির কয়েকটি উদাহরণ দিন।

উত্তর : অন্ত্যজ জাতি অথবা অস্পৃশ্য শ্রেণিসমূহ ব্যাধ/বনার, কাপালিক/কোল, কঞ্চ হাড়ি, ডোম, বাগতিত (বাগদি), শরক (যারা প্রাচীন শ্রবক সম্প্রদায়ের একটি অংশ), বলগ্রাহী ও চণ্ডাল।

প্রশ্ন : কোন্ যুগে লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না?

উত্তর : প্রাগৈতিহাসিক যুগে কোনো লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না। 

প্রশ্ন : প্রাগৈতিহাসিক কাল কাকে বলে?

উত্তর : মানব সভ্যতার সূচনা কাল থেকে লিখিত উপাদান প্রাপ্তি কালের মধ্যবর্ত সময় কালকেই প্রাগৈতিহাসিক কাল বলে।

প্রশ্ন : কত বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটে?

উত্তর : প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিচারে প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে মানুষে আবির্ভাব ঘটে।

প্রশ্ন : প্রাগৈতিহাসিক যুগকে কয় ভাগে ভাগ করা যায়?

উত্তর : প্রাগৈতিহাসিক যুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় যথা—প্রাচীন প্রস্তর, মধ প্রস্তর ও নব্য প্রস্তরযুগ।

প্রশ্ন : কোন্ গ্রন্থে ষোড়শ মহাজনপদের নাম উল্লেখ পাওয়া যায় ? 

উত্তর : বৌদ্ধ অঙ্গুত্তর নিকায় এবং জৈন ভগবতী সূত্র থেকে ষোড়শ মহাজনপদে নাম উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রশ্ন : কোন্ মহাজনপদ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল? 

উত্তর : মগধ মহাজনপদ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল।

প্রশ্ন : মগধকে কেন্দ্র করে কোন্ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর : মগধ কে কেন্দ্র করে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন : ক্লাসিসিজম কী ?

কাব্য, বৃত্রসংহার (হেমচন্দ্র)। পাশ্চাত্য— ইলিয়াড, ওডিসি, ভার্জিলের 'ইনিভ', মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট'।

প্রশ্ন : ক্লাসিসিজম-এর জন্ম কোথায়?

উত্তর : ক্লাসিসিজমের জন্ম প্রাচীন গ্রিসে ও প্রাচীন রোমে।

প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ক্লাসিক কাব্যের ভাবনা প্রথম কোথায় ধরা পড়ে? 

উত্তর : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ক্লাসিক কাব্যের ভাবনা প্রথম ধরা পড়ে পঞ্চাদশ শতাব্দীর প্রদমদিকে বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্মকীর্তন” কাব্যে।

প্রশ্ন : প্রথম ক্লাসিক কাব্য কে রচনা করেন?

উত্তর : ঊনবিংশ শতাব্দীতে রেনেসাঁসের কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত। কাব্যটি ছিল “মেঘনাদবধ”।

প্রশ্ন : বঙ্গ নামের উল্লেখ সর্বপ্রথম কোন্ গ্রন্থে পাওয়া যায়?

উত্তর : ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে সর্বপ্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

প্রশ্ন : ঐতরেয় আরণ্যকের রচিয়তা কে?

উত্তর : ঐতরেয় আরণ্যকের রচিয়তা হলেন মহিদাস।

প্রশ্ন : আরণ্যক-এর অর্থ কী ?

উত্তর : আরণ্যক-এর অর্থ হল বন্য বা বনজাত।

প্রশ্ন : কৌটিল্যের মতে প্রাচীন বঙ্গে কোন্ জিনিস উৎপন্ন হত?

উত্তর : উৎকৃষ্ট মানের সাদা ও নরম সুতি বস্ত্র উৎপন্ন হত (শ্বেতমস্নিগ্ধমদুকূলম)। 

প্রশ্ন : কোন্ রাজারা উত্তরবঙ্গ পিতৃভূমি বলে মনে করতেন?

উত্তর : পাল রাজারা উত্তরবঙ্গ কে তাদের পিতৃভূমি বলে মনে করতেন। 

প্রশ্ন : বরেন্দ্র শব্দের উৎপত্তি কোন্ শব্দ থেকে?

উত্তর : বারিন্দ্রী থেকে বরেন্দ্র শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে।

প্রশ্ন : বরেন্দ্রভূমির বর্তমান অবস্থান কোথায় ?

উত্তর : বর্তমান করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরের লালমাটি সমৃদ্ধ অঞ্চলই বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত।

প্রশ্ন : গঙ্গারিডই' শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে?

উত্তর : ‘গঙ্গারিডই' শব্দের উৎপত্তি “গঙ্গারিড” থেকে। ধারণা করা হয়, গঙ্গারিড 

উত্তর : ক্লাসিসিজম হল একটি সাহিত্যিক মতবাদ, একটি সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের গঙ্গাহৃদ বা গঙ্গাহৃদি শব্দের গ্রিক রূপ। অর্থাৎ গঙ্গা হৃদয়ে যার লোকে যাকে বলে 'ধ্রুপদী সাহিত্য'।

প্রশ্ন : ধ্রুপদী সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য কী?

উত্তর : ধ্রুপদী সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল সুসংযত রীতি, গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষা, ঐতিহ্যে অনুবর্তন।

প্রশ্ন : কয়েকটি ধ্রুপদী সাহিত্যের উদাহরণ দিন।

উত্তর : কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধ্রুপদী সাহিত্য হল রামায়ণ, মহাভারত, মেঘনাদব বক্ষে গঙ্গা প্রবাহিত'।

প্রশ্ন : গঙ্গারিডই রাজ্যের রাজধানীর নাম কী ছিল?

উত্তর : বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড়ে।

প্রশ্ন : টলেমি গঙ্গারিডাই-এর অবস্থান কোথায় উল্লেখ করেছেন?

উত্তর : টলেমির মতে গঙ্গারিডাই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী গঙ্গার সর্বপশ্চিম এবং সর্বপূর্বের নদীমুখ পর্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল।

প্রশ্ন : ইন্ডিকা কে রচনা করেন?

উত্তর : ইন্ডিকা রচনা করেন গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস।

প্রশ্ন : গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস-এর মতে গঙ্গারিডই-এর অবস্থান কোথায় 

উত্তর : গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তাঁর “ইন্ডিকা” গ্রন্থে “গঙ্গারিডই” রাজ্য সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙলা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।

প্রশ্ন : গঙ্গারিডাইদের কতজন সৈন্য ছিল?

উত্তর : মেগাস্থিনিস এর মতে গঙ্গারিডাই এদের রাজার ১০০০ অশ্বারোহী, ৭০০ হস্তি এবং ৬০০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে সজ্জিত সেনাবাহিনী ছিল।

প্রশ্ন : প্রিনি কে ছিলেন?

উত্তর : প্রিনি ছিলেন একজন রোমান লেখক।

প্রশ্ন : প্লিনির মতে গঙ্গারিডাই-এর মধ্য দিয়ে কোন নদী প্রবাহিত হয়েছিল? 

উত্তর : প্লিনির মতে ‘গঙ্গারিডই” রাজ্যের ভিতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে।

প্রশ্ন : প্লিনি বর্ণিত গঙ্গার দক্ষিণ অংশের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ কেমন কালো? 

উত্তর : প্লিনি বর্ণিত গঙ্গার দক্ষিণ অংশের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ ছিল কালো। 

প্রশ্ন : গঙ্গারিড (Gangarid) থেকে আর কোন্ কোন্ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে 

উত্তর : গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিডেই এবং গঙ্গারিদম শব্দরূপগুলির উৎপত্তি গঙ্গারিড (Gangarid) থেকে।

প্রশ্ন : 'গঙ্গাহৃদ' শব্দের গ্রিক রূপ কী?

উত্তর : 'গঙ্গাহৃদ' শব্দের গ্রিক রূপ হল গঙ্গারিড।

প্রশ্ন : গঙ্গাহৃদ শব্দের অর্থ কী?

উত্তর : গঙ্গাহৃদ শব্দের অর্থ হল 'যে ভূমির বক্ষে গঙ্গা প্রবাহিত' (গঙ্গাহৃদ > গজারির > গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিড এর বহুবচনার্থে)।

প্রশ্ন : উয়ারি-বটেশ্বর কী?

উত্তর : উয়ারী-বটেশ্বর হল বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। আসলে এটি একটি প্রাচীন গ্রাম।

প্রশ্ন : উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান কোথায় ?

উত্তর : বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবিষ্যত উয়ারী এবং বটেশ্বর।

প্রশ্ন : কোন্ যুগে ওয়ারী-বটেশ্বর গঠিত হয়েছিল ?

উত্তর : প্লাইসটোসিন যুগে।

প্রশ্ন : উয়ারী-বটেশ্বর থেকে কত প্রাচীন দুর্গনগর আবিষ্কার হয়েছে?

উত্তর : গ্রাম দুটিতেই নিবিড় অনুসন্ধান ও সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দূর্গনগর।বাংলার প্রাথমিক ইতিহাস ৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত

প্রশ্ন : উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব কে প্রথম উপলব্ধি করেন ? 

উত্তর : ১৯৩০-এর দশকে মুহম্মদ হানিফ পাঠান নামের স্কুল শিক্ষক। 

প্রশ্ন : কত খ্রিস্টাব্দে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের কাজ সম্পন্ন করা হয়?

উত্তর : ১৯৯৬ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

প্রশ্ন : প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উয়ারী প্রত্নস্থল কতগুলো মাটির দুর্গ প্রাচীর আবিষ্কৃত হয়েছে? 

উত্তর : প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উয়ারী প্রত্নস্থল থেকে চারটি মাটির দুর্গপ্রাচীর আবিষ্কৃত হয়েছে

প্রশ্ন : প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উয়ারী প্রত্নস্থলে আবিষ্কৃত মাটির দুর্গপ্রাচীরগুলির আয়তন কত ?

উত্তর : প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উয়ারী প্রত্মস্থলে আবিষ্কৃত মাটির দুর্গ প্রাচীরগুলির আয়তন হল ৬০০ মি. x ৬০০ মি.।

প্রশ্ন : অসম রাজার গড় কী ?

উত্তর : উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নস্থলে অবস্থিত একটি মাটির বাঁধ। 

প্রশ্ন : অসম রাজার গড়ের আয়তন কত?

উত্তর : প্রায় ৫.৮ কি. মি. দীর্ঘ, ২০ মি. প্রশস্ত ও ১০ মি. উঁচু

প্রশ্ন : উয়ারী-বটেশ্বর-এর সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোন্ কোন্ দেশের যোগাযোগ ছিল ?

উত্তর : উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল।

প্রশ্ন : উয়ারী বটেশ্বর থেকে কোন্ কোন্ প্রত্নসামগ্রীর আবিষ্কৃত হয়েছে? 

উত্তর : উয়ারী বটেশ্বর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে রুলেটেড মৃৎপাত্র, স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি, স্বর্ণ আবৃত কাঁচের পুঁতি, টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ ইত্যাদি সব উপকরণ। প্রশ্ন : সোনাগাড়া কী ?

উত্তর : উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলের আরেক নাম সোনাগাড়া।

প্রশ্ন : উয়ারী-বটেশ্বরে কোন্ ধরনের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে?

উত্তর : উয়ারী-বটেশ্বরে জনপদে শ্রেণি ও সামাজিক শ্রেণি এ দু'প্রকারের ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।

প্রশ্ন : জনপদ শ্রেণীর মুদ্রাগুলো উয়ারী-বটেশ্বরে কতদিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল? 

উত্তর : জনপদ শ্রেণির মুদ্রাগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৬-৪ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

প্রশ্ন : মৌর্য শাসনের পর বাংলাতে কোন শাসনের আগমন ঘটে? 

উত্তর : মৌর্য শাসনের পর বাংলাতে শুঙ্গ শাসনের আগমন ঘটে। 

প্রশ্ন : শুঙ্গ শাসনকালে শক্তিশালী শাসক কারা ছিলেন?

উত্তর : পুষ্যমিত্র শুঙ্গ, অগ্নিমিত্র এবং দেবভূতি ছিলেন এই সময়ের শক্তিশালী শাসক 

প্রশ্ন : শুঙ্গ শাসনের পর বাংলাতে সম্ভাব্য কোন রাজবংশের আবির্ভাব ঘটে? 

উত্তর : শুঙ্গ শাসন অবসানের পরেই বাংলাতে কুষাণদের আগমন ঘটে থাকতে পারে, যাদের মুদ্রা প্রাচীন বাংলা থেকে পাওয়া গেছে।

প্রশ্ন : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ কী ?

উত্তর : মৌর্য রাজশক্তির দুর্বলতা এবং সাম্রাজ্যের বিশালতা।

প্রশ্ন : কুবাণদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল?

উত্তর : কুষাণদের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য এশিয়ার ব্যাক্ট্রিয়া ও স্কাইথিয়া অঞ্চল।

প্রশ্ন : কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

উত্তর : সম্রাট কুজুল কদফিসেস ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। 

প্রশ্ন : ব্যাকটীয়া অঞ্চল বলতে কোন অঞ্চলকে বোঝানো হতো?

উত্তর : ব্যাকট্রীয়া বলতে আজকের দিনের আফগানিস্তান অঞ্চলকে বোঝানো হতো 

প্রশ্ন : কত শতাব্দীতে কৃষাণ সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটেছিল?

উত্তর : খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে কুষাণ সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটেছিল।

প্রশ্ন : কুরাণ সাম্রাজ্য কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল?

উত্তর : কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল পূর্ব বিহার পর্যন্ত।

প্রশ্ন : প্রথম কণিষ্ক বাংলার কোন অঞ্চল জয় করেছিলেন?

উত্তর : কিছু কিছু গবেষক তথ্য পণ্ডিত মনে করেন যে প্রথম কণিষ্ক সম্ভবত বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের কিছু অংশ জয় করেছিলেন।

প্রশ্ন : কোথায় কোথায় কুষাণ মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে?

উত্তর : বিহার, ওড়িশা এবং বাংলার বিভিন্ন স্থানে কুষাণ মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। 

প্রশ্ন : ভীম কদফিসেস কে ছিলেন?

উত্তর : ভীম কদফিসেস (রাজত্বকাল ১০-১০০ খ্রিস্টাব্দ) একজন কুষাণ, সম্রাট ছিলেন।

প্রশ্ন : 'রবাতক শিলালিপি' কোথায় আবিস্তৃত হয়েছে? 

উত্তর : ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের রবাতক নামক স্থানে।

প্রশ্ন : কোন শিলালিপিতে কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের পিতৃপুরুষদের নাম পাওয়া যায়?

উত্তর : রবাতক শিলালিপি থেকে কুবাণ সম্রাট কণিষ্কের পিতৃপুরুষদের নাম পাওয়া

প্রশ্ন : কণিষ্কের পিতার নাম কী ?

উত্তর : কণিষ্কের পিতার নাম ভীম, কদফিসে।

প্রশ্ন : কুষাণ সম্রাটদের বাংলায় কোন ধরনের মুদ্রার প্রচলন করেন ? 

উত্তর : কুষাণ সম্রাটরা প্রথম বাংলায় স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন।

প্রশ্ন : কোন কুষাণ সম্রাট প্রথম স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন? 

উত্তর : ভীম কন্দফিসেস।

প্রশ্ন : কুষাণ মুদ্রার উপরিপৃষ্ঠে কীসের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ রয়েছে? 

উত্তর : বেদিতে যজ্ঞরত রাজার প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ রয়েছে।

প্রশ্ন : গোটার্জেস কে ছিলেন?

উত্তর : গোটার্জেস ছিলেন একজন পার্থিয়ান রাজা।

প্রশ্ন : কোন চৈনিক পরিব্রাজক গুপ্তদের আদি বাসস্থান বাংলার মুর্শিদাবাদে ছিল বলে বর্ণনা করেছেন?

উত্তর : চৈনিক পরিব্রাজক ই-ৎসিঙ।

প্রশ্ন : এলাহাবাদ প্রশস্তি কার লেখা?

উত্তর : সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণের লেখা এলাহাবাদ প্রশস্তি।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার গুপ্ত প্রশাসন সম্পর্কে জানার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের নাম লিখুন।

উত্তর : সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি এবং প্রথম কুমারগুপ্তের বৈগ্রাম তাম্রশাসন। 

প্রশ্ন : গুনাইঘর তাম্রশাসন থেকে কার সম্পর্কে জানা যায়?

উত্তর : গুনাইঘর তাম্রশাসন থেকে বৈন্যগুপ্ত সম্পর্কে জানা যায়। 

প্রশ্ন : দামোদরপুর তাম্রশাসন কার সঙ্গে সম্পর্কিত? 

উত্তর : দামোদরপুর তাম্রশাসন বধুগুপ্তের সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় 'বীথি' কী? 

উত্তর : গুপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ‘বিষয়'-এর পরবর্তী প্রশাসনিক ইউনিট ‘বীথি'। 

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় 'গ্রাম' কী ?

উত্তর : গুপ্ত যুগকে বাংলার সংস্কৃত ভাষা চর্চা ও সাহিত্য উন্নয়নের স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

প্রশ্ন : গুপ্ত যুগের ভূমি নিবন্ধন বিভাগ সম্পর্কিত তথ্যের একমাত্র উৎস কী? 

উত্তর : তাম্রশাসনগুলো হল গুপ্ত যুগের ভূমি নিবন্ধন বিভাগ সম্পর্কিত তথ্যে একমাত্র উৎস।

প্রশ্ন : গুপ্ত যুগে ভূমি নিবন্ধনের বিশেষ কর্মকর্তাকে কী বলা হত ? 

উত্তর : গুপ্ত যুগে ভূমি নিবন্ধনের বিশেষ কর্মকর্তাকে বলা হতো পুস্তপাল। 

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসনে পুস্তপালের প্রধান কাজ কী ছিল?

উত্তর : জমির অবস্থান ও প্রকৃতি, জমির সীমা, মালিকানা এবং মূল্যমান সম্পর্কি তথ্যাদি সংরক্ষণ করাই ছিল পুস্ত পালের প্রধান কাজ।

প্রশ্ন : ই-ৎসিঙ কত খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে আসেন?

উত্তর : ই-ৎসিঙ ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে আসেন।

প্রশ্ন : হুই লন কে ছিলেন?

উত্তর : হুই লন ছিলেন একজন চীনা পরিভ্রমণকারী।

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসনে ভুক্তি কী?

উত্তর : গুপ্ত প্রশাসনে ভুক্তি হলো সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক ইউনিট।

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসনে উপারিক কাদের বলা হত?

উত্তর : ভুক্তি' প্রশাসককে ‘উপারিক’ বা উপারিক মহারাজ' বলা হতো। 

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়' কী ?

উত্তর : গুপ্ত প্রশাসনে ‘বিষয়' ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট। 

প্রশ্ন : বিষয়' প্রশাসকের উপাধি কী ছিল ?

উত্তর : ‘বিষয়' প্রশাসকের উপাধি ছিল 'কুমারমাত্য' এবং 'আযুক্তক'। 

প্রশ্ন : 'নগরশ্রেষ্ঠী' কাদের বলা হত?

উত্তর : নগরশ্রেষ্ঠীরা ছিলেন সাধারণত শহরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকার গিল্ড সংস্থা

প্রশ্ন : গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় গ্রামের প্রধানদের কী বলা হতো? 

উত্তর : গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় গ্রামের প্রধানদের বলা হতো গ্রামীক। 

প্রশ্ন : গুপ্তযুগে ভূমি পরিমাপের এককগুলি কী ছিল ?

উত্তর : গুপ্তযুগে 'কূল্যবাপ' ও 'দ্রোণবাপ' ছিল ভূমি পরিমাপের একক। 

প্রশ্ন : অগ্রহার কী ?

উত্তর : অগ্রহার হল নিষ্কর ভূমিদান।

প্রশ্ন : ব্রাহ্মদেয় কী ?

উত্তর : গুপ্তযুগে সম্রাট কর্তৃক ব্রাহ্মণদের নিস্কর ভূমিদানকে বলা হতো রাত্মদেয়। 

প্রশ্ন : গুপ্তযুগে বাংলায় ব্রাহ্মণদের কতগুলো গোত্র ছিল ?

উত্তর : গুপ্তযুগে বাংলায় ব্রাহ্মণদের সকলেই বাজসনেয়ী, ছান্দোগ্য, বাহুচা, চারকা এবং তৈত্তিরীয়— এই পাঁচটি বেদ-পরিচয় বা গোত্রের অন্তর্গত।

প্রশ্ন : পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের নাম কী?

উত্তর : পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের নাম গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলির নাম কী?

উত্তর : প্রাচীন বাংলার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলি হল-পুণ্ড্রবর্ধন, হরিকেল, সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র, গৌড় প্রভৃতি।

প্রশ্ন : কত খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিভক্ত হয়?

উত্তর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিভক্ত হয়।

প্রশ্ন : সেন্ট মার্টিনের প্রবাল দ্বীপের অবস্থান কোথায় ?

উত্তর : সেন্ট মার্টিনের প্রবাল দ্বীপের অবস্থান বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে।

প্রশ্ন : সেন্ট মার্টিনের প্রবাল দ্বীপ কী জন্য বিখ্যাত?

উত্তর : সেন্ট মার্টিনের প্রবাল দ্বীপ প্রচুর পরিমাণে নারকেলের জন্য বিখ্যাত।

প্রশ্ন : পুণ্ড্রবর্ধন কী?

উত্তর : পুণ্ড্রবর্ধন হল প্রাচীন বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ।

প্রশ্ন : পুণ্ড্রবর্ধন এর নামকরণ কিভাবে হয়?

উত্তর : পুন্ড্রবর্ধন এর নামকরণ হয় এখানে বসবাসকারী পুণ্ড্র জনগোষ্ঠীর নাম অনুসারে।

প্রশ্ন : পুণ্ড্র এর নাম সর্বপ্রথম কোথায় উল্লেখিত হয়েছে?

উত্তর : ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে প্রথমবারের মতো উপজাতি গোষ্ঠী রুপে পুণ্ড্রের নাম উল্লেখ রয়েছে।

প্রশ্ন : পুণ্ড্ররা কোন কোন জাতির সমন্বয়ে গঠিত?

উত্তর : পুণ্ড্ররা মুলত অস্ত্র, শবর, পুলিন্দি ও মুতিব এই চার জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে পুণ্ড্ররা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রশ্ন : গঙ্গারিডাই কি

উত্তর : খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতকের একটি অজ্ঞাত রাজ্য। ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ অঞ্চল বা বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এ রাজ্য বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করা হয়।

প্রশ্ন : কোন গ্রিক পর্যটকদের লেখনীতে গঙ্গারিডাই রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে? 

উত্তর : গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে এই রাজ্যের উল্লেখ করেন।

প্রশ্ন : চন্দ্রকেতুগড় এর অবস্থান কোথায় ?

উত্তর : চন্দ্রকেতুগড় এর অবস্থান বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। 

প্রশ্ন : গঙ্গারিডাই এর রাজধানীর নাম কী ছিল

উত্তর : বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড় সম্ভবত উল্লিখিত বিখ্যাত প্রাচীন বন্দর-রাজ্য ”গঙ্গারিদই”-এর রাজধানী বা ”গাঙ্গে” বন্দর।

প্রশ্ন : প্রাচীনকালে চন্দ্রকেতুগড় এর সঙ্গে আর কোন দেশের বাণিজ্য চলত? 

উত্তর : বিদ্যাধরী নদী সংলগ্ন এই প্রত্নস্থলটির সঙ্গে জলপথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত রোমের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে। 

প্রশ্ন : উত্তরবঙ্গের প্রধান নদীগুলির নাম কী ?

উত্তর : উত্তরবঙ্গের প্রধান নদীগুলোর ভেতরে আছে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, মরা তিস্তা, জলঢাকা, দুধকুমার, গুমতি, করতোয়া, যমুনেশ্বরী প্রভৃতি। 

প্রশ্ন : গঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায় ?

উত্তর : হিমালয়ের গোমুখ হিমবাহ থেকে গঙ্গার উৎপত্তি হয়েছে।

প্রশ্ন : পদ্মা নদীর উৎপত্তি কোথায় হয়েছে?

উত্তর : বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী পদ্মা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

প্রশ্ন : গঙ্গার দুটি শাখা নদীর নাম লিখুন?

উত্তর : গঙ্গার দুটি শাখা নদীর নাম বল পদ্মা এবং ভাগীরথী।

প্রশ্ন : টলেমি কে ছিলেন?

উত্তর : টলেমি ছিলেন একজন গ্রিক গণিতবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, ও জ্যোতিষ। 

প্রশ্ন : গাঙ্গেয় প্লাবন ভূমির আয়তন কত?

উত্তর : গাঙ্গেয় প্লাবন ভূমির আয়তন প্রায় ২৩,২১৩ বর্গ কিলোমিটার। 

প্রশ্ন : তাম্রলিপ্ত কী ?

উত্তর : প্রাচীন মানব বসতিস্থল তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত এর অবস্থান ছিল গঙ্গা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে তার কাছে।

প্রশ্ন : প্রাচীন তাম্রলিপ্ত কী জন্য বিখ্যাত ছিল?

উত্তর : প্রাচীন তাম্রলিপ্তি তৎকালীন বাণিজ্যপথের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এখানে ব্যবসায়ী, পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

প্রশ্ন : সমতট বলতে কী বোঝায়?

উত্তর : সমতট বাংলার একটি প্রাচীন ভৌগোলিক অঞ্চল। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ব্রহ্মপুত্র নদীর মুখে বঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে ছিল সমতটের অবস্থান। 

প্রশ্ন : গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এর অপর নাম কী ?

উত্তর : গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এর অপর নাম গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলায় কত ধরনের ধান চাষ হত?

উত্তর : প্রাচীন বাংলার কৃষিতে তিন ধরনের ধান চাষ হত যথা আউশ আমন এবং বুরো।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলায় উৎপাদিত প্রধান অর্থকরী ফসলগুলি কী ছিল ? 

উত্তর : প্রাচীন বাংলায় উৎপাদিত প্রধান অর্থকরী ফসল হল পাট, ইক্ষু, রেশন, তুলা প্রভৃতি।


প্রশ্ন : প্রাচীন হরিকেল' সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টিকা লিখুন?

উত্তর : চতুর্থ শতক থেকে গুপ্তযুগ, গুপ্ত পরবর্তী পাল, সেন প্রভৃতি আমলে উৎকীর্ণ শিলালিপি ও সাহিত্য গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার যে ১৬টি জনপদের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হল 'হরিকেল'। যার সর্বপ্রথম উল্লেখ চৈনিক বিবরণে পাওয়া যায়। চৈনিক পর্যটক ইউচিৎ সপ্তম শতাব্দীতে সিংহল থেকে জলপথে হরিকেলে এসেছিলেন এবং এটি পূর্বভারতের পূর্বপ্রান্তবর্তী অঞ্চল হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন। এর থেকে অনুমান করা হয় যে, হরিকেল ছিল বাংলাদেশের পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তবর্তী অঞ্চল। চট্টগ্রামে আবিষ্কৃত কান্তিদেবের তাম্রলিপি এরূপ অনুমানের ভিত্তিকে মজবুত করেছে। তাছাড়া হরিকেল নামাঙ্কিত কিছু মুদ্রার চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া গেছে। রাজশেখরের কর্পূরমজুরী গ্রন্থে পূর্ব দেশীয় হরিকেল জলপদের নারীদের প্রশংসা করা হয়েছে। উপরোক্ত তথ্যের আলোকে অনেকেই হরিকেলকে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জনপদ বলে অনুমান করেন। এবং সম্ভবত চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল ছিল প্রাচীন হরিকেল। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে বঙ্গ, সমতট ও হরিকেলকে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রুদ্রাক্ষ মাহাত্ম্য ও রূপচিত্তামণিকোশ গ্রন্থদ্বয়ে হরিকেল ও সিলেটকে অভিন্ন অঞ্চল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত তথ্য হতে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, হরিকেল জনপদ প্রাচীনযুগে এক ও অভিন্ন অথবা অপর একটি জনপদের অংশ বিশেষ ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্প্রসারণ হরিকেল জনপদের পরিধিরও বিস্তৃতি ঘটিয়েছিল। রোহিতাগিরির সামন্ত (লালমাই) ত্রৈলোক্যচন্দ্র পরবর্তীতে হরিকেল রাজ্যের ক্ষমতার আধার হয়েছিল। চন্দ্রলিপিতে উল্লেখিত হরিকেল রাজ্যের অবস্থিতি ছিল লালমাই, সমতট ও চন্দ্রদ্বীপ সংলগ্ন এবং পরবর্তীতে চন্দ্রবংশীয় নৃপতিরা চন্দ্রদ্বীপ ও সমতট অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব লাভ করেছিলেন। সুতরাং চন্দ্রবংশীয়দের হাতে হরিকেল রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল এটিই প্রমাণ হয়। এই সময় হরিকেল রাজ্যের পরিধি কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল এবং সম্ভবত এই কারণেই ত্রৈলোক্যচন্দ্র হরিকেল রাজ্যের ক্ষমতার আধার হয়েছিলেন। তাছাড়া চন্দ্র রাজাদের ক্ষমতার উন্মেষ বঙ্গ-সমতট এলাকায় বিস্তার ঘটার ফলে হরিকেল জনপদের পরিসীমা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যা উপরোক্ত তথ্য দ্বারা সমর্থিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পান্ডুলিপিতে সিলেটকেই হরিকেল বলা হয়েছে এর থেকে পণ্ডিতগণ সিলেট পর্যন্ত হরিকেল জনপদের সম্প্রসারণের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। সুতরাং হরিকেল ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চল। ঐতিহাসিকগণ এই অঞ্চলকে হরিকেল জনপদের আদি অবস্থিতির কথা বলেছেন। পরবর্তীতে হরিকেল রাজাদের শাসনকালে সমতট অঞ্চল পর্যন্ত হরিকেল জনপদের সীমা সম্প্রসারিত হয়। এবং চন্দ্রবংশীদের হাতে এটির আরও সম্প্রসারণ ঘটে। সম্ভবত এই সময় হরিকেলের ভৌগোলিক পরিধি সর্বকালের থেকেও বেশি বিস্তার লাভ করেছিল। 

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার উপ-অঞ্চল নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখো?

উত্তর : প্রাচীন যুগে বাংলা বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল এবং এই জনপদবাসীরাই স্ব-স্ব জনপদের নামেই পরিচিতি লাভ করে। তবে ভৌগোলিক পরিবেশ একদিকে যেমন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের (নদীর ভাঙা-গড়া) সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার বা হ্রাসের মাধ্যমে জনপদগুলোর আয়তনও পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এসব পৃথক পৃথক অংশগুলো এককথায় ‘জনপদ' নামে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রাচীন কাল থেকে আরম্ভ করে আনুমানিক ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে প্রাচীন বাংলা পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সূক্ষ্ম, তাম্রলিপি, সমতট, বঙ্গ ইত্যাদি জনপদে বিভক্ত। এই জনপদগুলো স্বতন্ত্র ও পৃথক, মাঝে মাঝে বিরোধ মিলনে একের সাথে অন্যের যোগাযোগের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। তবে প্রত্যেকেই যে স্বতন্ত্র সে বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত।

পুণ্ড্র বা বরেন্দ্রী : পুণ্ড্র ছিল পূর্বাঞ্চলের জনপদসমূহের মধ্যে খুব সম্ভবত প্রাচীনতম। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের (আনুমানিক) মহাস্থান ব্রাক্ষ্মী লিপিতে উল্লিখিত পুদনগল (পুণ্ড্রনগর) এবং বগুড়া যে অভিন্ন তা একাধিক উৎস থেকে প্রমাণ করা যায়। প্রাচীন এই জনপদের সীমানা চিহ্নিত করে ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, “পুণ্ড্রবর্ধনের কেন্দ্র বা হৃদয়স্থানের একটি নতুন নাম পাইতেছি দশম শতক হইতে; এ নাম বরেন্দ্র অথবা বরেন্দ্রী।”

রাঢ়, তাম্রলিপ্তি : বিভিন্ন ঐতিহাসিক উৎস থেকে বলা যায় যে, রাঢ় বলতে পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চলকেই বুঝানো হত। এটি গঙ্গা নদীর দক্ষিণ ও পশ্চিম ভাগে সীমাবদ্ধ ছিল। জনপদটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল দক্ষিণ রাঢ় এবং অন্যটি ছিল উত্তর রাঢ়। এই উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ই ছিল যথাক্রমে বজ্রভূমি ও সূক্ষ্মভূমি। রাঢ়ের প্রধান নগর বা রাজধানী ছিল কোটিবর্ষ। রাঢ় বা সূাদেশের অন্তর্গত তাম্রলিপ্তের কথা টলেমির ভূগোলে উল্লিখিত ছিল। অনেক ঐতিহাসিক মেদিনীপুর জেলার পূর্বপ্রান্ত অবস্থিত আধুনিক তমলুককে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বলে চিহ্নিত করেছেন। শুধু বাংলা নয় এটি প্রাচীন ভারতেরও পূর্বাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বন্দর।-

গৌড় : ধারণা করা হয় যে, গুড় উৎপাদনের কেন্দ্র বলে গৌড় নগর ও দেশের নামের উদ্ভব হয়। আর হয়তো এই গৌড়নগরকে ঘিরেই পরে গৌড় জনপদ গড়ে উঠেছিল। “গৌড়” নামটি সুপ্রাচীন হলেও এর অবস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা কষ্টসাধ্য। বাংলার প্রাচীন জনপদগুলো যে যুগে যুগে সীমানা সম্প্রসারণ করেছে তার বড় উদাহরণ হল গৌড়। এই জনপদের খ্যাতি এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, সমগ্র বাংলাকেই সময়ে সময়ে গৌড়দেশ বিবেচনা করা হত।পূর্ব ভারতীয় দেশসমূহের সামগ্রিক নাম হিসেবে এমনকি উত্তর ভারতের আর্যাবর্তের নাম হিসেবেও কখনো কখনো গৌড়ের ব্যবহার দেখা যায়। সেনবংশীয় রাজারা ‘গৌড়েশ্বর' উপাধি গ্রহণ করে গৌরববোধ করতেন।

বঙ্গ : বঙ্গ একটি প্রাচীন জনপদ। ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে একটি উপজাতির নাম হিসেবে বঙ্গের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত, রামায়ণ ও হরিবংশেও রয়েছে বঙ্গ প্রসঙ্গ। মহাভারতের আদি অন্যান্য জনপদের সাথে উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গের নাম। মহাকবি কালীদাসের রঘুবংশ কাব্যে আছে বঙ্গের অবস্থান ও সীমানা সম্পর্কিত কিছু তথ্য। তিনি ভাগীরথী ও পদ্মার স্রোত মধ্যবর্তী এলাকায় যে ত্রিভুজাকৃতি ব-দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে তাকেই বঙ্গদের অঞ্চল বলেছেন। আর এ অঞ্চলই সম্ভবত টলেমির ‘গঙ্গরিডাই'। প্রাচীন শিলালিপিতে বঙ্গের দুটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়। একটি বিক্রমপুর বঙ্গ অন্যটি নাব্য বঙ্গ। বর্তমানে নাব্য বলে কোনো জায়গা নেই।

সমতট : পট্টিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার জনপদ সমতট নামটি বর্ণনামূলক এবং এর অর্থ তটের সমান্তরাল। চতুর্থ শতকের সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ লিপিতে তাঁর রাজ্যের পূর্ব সীমায় সমতটের উল্লেখ রয়েছে। কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, সমতট বঙ্গের পূর্বে অবস্থিত ছিল।

হরিকেল : হরিকেল জনপদের কথা প্রথম জানা যায় প্রথম শতকের চট্টগ্রামে প্রাপ্ত লিপিতে। চন্দ্রবংশীয় লিপিতেও হরিকেল রাজ্যের কথা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দুটি প্রাচীন গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে হরিকোল (হরিকেল) ও বর্তমান অনেকে ধারণা করেন যে হরিকেল জনপদ, ছিল না, এটি বঙ্গের সাথে যুক্ত ছিল।

প্রশ্ন : বর্ণপ্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী? বর্ণ ও জাতি ধারণার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করুন?

উত্তর : প্রাচীন ভারতের ঋকবৈদিক যুগে আর্য সমাজে বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে ভারতে আগমনের পূর্বে আর্যসমাজে বর্ণপ্রথার প্রচলন ছিল না, আর্যরা ভারতে আসার পর ঋকবৈদিক যুগে আর্যসমাজে বর্ণপ্রথার প্রচলন ঘটে । বৈদিক বর্ণপ্রথা মূল্য বৃত্তি বা কাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। যাগযজ্ঞ পূজার্চনার পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ, ব্রাহ্মণ দেশশাসক ও যোদ্ধারা ক্ষত্রিয়, ব্যবসায়ীরা বৈশ এবং উপরিউক্ত তিন বর্ণকে সেবাদানকারীরা শূদ্র বলে পরিচিত হত। ধীরে ধীরে এই বর্ণব্যবস্থা একটি শ্রেণিবাচক ধারণায় পরিণত হয়। বর্ণ প্রথা মূলত আর্যদের সমাজেই প্রচলিত হয়েছিল। আর্য সমাজের বাইরে অবস্থানকারী জনসমাজে এই প্রথার প্রচলন ছিল না। প্রাচীনকালে ঋকবৈদিক যুগের এই বর্ণপ্রথা কালক্রমে ভারতীয় সমাজে জাতি ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। অনেক সময়ই ‘বর্ণ' ও 'জাতি' শব্দ দুটিকে অভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হলেও ‘বর্ণ’ ও ‘জাতি’ দুটি পৃথক সত্তা। স্বাভাবিকভাবেই বর্ণ ও জাতির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা

যায়।

প্রথমত, বৈদিক যুগের প্রথমদিকে চারটি বর্ণকে কেন্দ্র করে মাত্র চারটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় তখনও পর্যন্ত জাতির উদ্ভব হয়নি কিন্তু পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজে নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হলে পুরোনো বর্ণভিত্তিক জনগোষ্ঠীগুলি থেকেই নতুন নতুন জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়।

দ্বিতীয়ত, বৈদিক সমাজের মতোই পরবর্তী বৈদিক সমাজেও বর্ণ ছিল সংখ্যায় চারটি, অন্যদিকে পরবর্তী বৈদিক সমাজে বহু জাতি ছিল। প্রতিটি বর্ণের মধ্যেই আমরা জাতির অস্তিত্ব দেখতে পাই।

তৃতীয়ত, শুরুতে পেশা বা বৃত্তির ওপর ভিত্তি করে বর্ণব্যবস্থা চালু হলেও পরে এই বিষয়টি মুখ্য থাকেনি, কিন্তু জাতি হল একটি বৃত্তি বা পেশাবাচক ধারণা। বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশার জনগোষ্ঠী নিয়ে জাতি গড়ে ওঠে।

চতুর্থত, বর্ণপ্রথায় ক্রমানুসারে চারটি বর্ণ হল- ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ ও শূদ্র। এক্ষেত্রে সর্বত্র এই ক্রমপর্যায়টি একই রকম- এই নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই, কিন্তু জাতি প্রথার বর্ণ ব্রাক্ষ্মণ এবং চতুর্থ বর্ণ শূদ্রকে নিয়ে সমস্যা না থাকলেও অন্য দুটি জাতি এক অঞ্চলে বৈশ্য কিন্তু অন্য অঞ্চলে ক্ষত্রিয় বলে বিবেচিত হতে হত।

পঞ্চমত, বর্ণপ্রথায় অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব ছিল না। বর্ণগুলি ছিল মুক্ত ও উদার। যোগ্যতা অনুসারে কেউ একবর্ণ থেকে অন্য বর্ণে উন্নীত হতে পারত কিন্তু জাতি প্রথায় অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব ছিল। জাতিগুলি মুক্ত বা উদার ছিল না এবং জাতিভেদভিত্তিক সমাজ ছিল স্থবির।

ষষ্ঠত, বর্ণের মূল গঠন শক্তি হল ধর্ম, বংশানুক্রমিকতা এখানে গৌণ, মোটামুটি একই মর্যাদাসম্পন্ন বিভিন্ন জাতি একই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে জাতির মূল গঠনশক্তি ধর্ম হলেও কালক্রমে এই গঠনসক্তি বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। বর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো একটি জাতির সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য থাকতে পারে।

সপ্তমত, হিন্দু সমাজে বর্ণ হল একটি ধারণাগত কাঠামো মাত্র এর বাস্তবতা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু জাতি হল হিন্দু সমাজের বাস্তব অবস্থার পরিচয়। এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাঙালি জাতির ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখুন?

উত্তর : প্রাচীন বাংলার সমাজ বর্ণাশ্রম প্রথায় বিভক্ত ছিল। এই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় আর্যদের চার বর্ণের বিন্যাস যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি আর্যপূর্ব অনার্য সংস্কার ও সংস্কৃতি এই বর্ণশ্রমের কাঠামো ও আদর্শের মধ্যে সমন্বিত হয়েছে। তাই দেখা যায় যে প্রাচীন বাংলার সমাজ যেমন বিভিন্ন বর্ণে, তেমনি বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বাংলার মূলগতভাবে তিনটি শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। উৎপাদিত ও সঞ্চিত ধনের তারতম্য অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রেণিতে নানা স্তরও বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন বাংলায় বৃত্তি বা জীবিকা বর্ণ নির্ভর এবং বর্ণ ছিল জন্ম নির্ভর। ব্রাহ্মণ থেকে আরম্ভ করে অন্ত্যজ চণ্ডাল পর্যন্ত অগণিত স্তরের অগণিত বৃত্তি এবং বৃত্তি ও শ্রেণি অনুযায়ী সেখানে বর্ণ ও শ্রেণি একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় পালযুগে বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেশ কয়েকটি বিভাগ ছিল- বিচার বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ, আয়-ব্যয় হিসাব বিভাগ, ভূমি ও কৃষি বিভাগ, পররাষ্ট্র বিভাগ, শান্তিরক্ষা বিভাগ, সৈন্য বিভাগ। সামগ্রিকভাবে একটি উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাক্ষ্য বহন করে। প্রাচীন বাংলার ধর্ম, কর্ম অনার্য ভাবধারা দ্বারাই লালিত হয়েছিল। হিন্দুর জন্মান্তরবাদ, পরলোক, প্রেততত্ত্ব, পিতৃতত্ত্ব, পিণ্ডদান, শ্রাদ্ধাদি প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আদি বণিকদের প্রভাবপুষ্ট। বাঙালির ব্রত পার্বণ, কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান অস্ট্রিক ভাবধারা পুষ্ট। পরবর্তীকালে এগুলি আর্য সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মণ্য সমাজে অনুমোদিত হয়ে যায়। এছাড়াও জৈনধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব এদেশে লক্ষ করা যায়। নাথধর্ম, তন্ত্রধর্ম প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত ছিল।

বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরিচয় ও তার উৎস সন্ধান করতে হয় অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় কৌম সমাজের মধ্যে। খাদ্যের মধ্যে ছিল ভাত-ঘি-ললিতা শাক-মাছ-মাংস প্রভৃতি। প্রিয় ফলের মধ্যে আম-জাম-তাল-আখের উল্লেখ পাওয়া যায়। শিকার, জনক্রীড়া, উদ্যানরচনা, নৃত্যনীতি, বাদ্যযন্ত্র বাদন, অভিনয়কলার প্রয়োগের উদাহরণ মেলে। এছাড়াও শান্ত, নিরোপদ্রব জীবনধারা, অতিথি পরায়ণতা বাঙালির বৈশিষ্ট্য রূপে কথিত হয়েছে। সমাজে কন্যা, নারী, বিধবা নারীর দুঃখদায়ী জীবনের কথা বলা হয়েছে। সামাজিক ধনোৎপাদনের উপায় ছিল মূলত তিনটি—কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য। ফসলের মধ্যে প্রধান ছিল ধান। লক্ষণ সেনের আমলের লিপিতে ধান ও ধানচাষের উল্লেখ আছে। 'রামচরিত' কাব্যের কবি প্রশস্তিতে ধানের খোলা বা মাড়াই স্থানের উল্লেখ আছে। ‘সদুত্তিকরণামৃতেও দুজন বাঙালি কবির মধ্যে বর্ষার ধানের ক্ষেত, আখের ক্ষেত, হেমন্তের শালি ধানের স্তূপ প্রভৃতির উল্লেখ আছে। এছাড়াও নদীমাতৃক বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাধান্য লক্ষিত হয়েছিল। বিভিন্ন গ্রন্থসূত্রে বাংলাদেশে প্রাপ্ত খনিজ দ্রব্য হীরা, মুক্তা, সোনা, রূপা, তামা, লোহা প্রভৃতি ও বস্ত্রশিল্পের উল্লেখ আছে। সামগ্রিক বিচারে একটি উন্নত ও স্থিতিশীল জাতির বৈশিষ্ট্যই বাঙালি জাতির ইতিবৃত্ত থেকে অনুমিত হয়।

প্রশ্ন : উয়ারী-বটেশ্বর সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাংলার গঙ্গারিডির কী কোনো সম্পর্ক ছিল?

উত্তর : প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রীরমাপদ চন্দ লিখেছেন, রাঢ়ে তখন পরাক্রান্ত গঙ্গারিডই রাজ্য প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীন রাঢ় এর অবস্থান ছিল বর্তমান পশ্চিমবাংলায়। ঐতিহাসিক শ্রীরমাপদ চন্দের বক্তব্য অনুযায়ী প্রাচীন বাংলার পশ্চিম অংশ গঙ্গা গঙ্গাঋদ্ধি (গঙ্গারডি) রাজ্যের অংশ ছিল। তা হলে, উয়ারী-বটেশ্বর কী প্রাচীন বাংলার গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের অংশের কিংবা উয়ারী বটেশ্বর কী গঙ্গাঋদ্ধি রাষ্ট্রের কেন্দ্র বা রাজধানি ছিল প্রখ্যাত ঐতিহাসিক দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন যে, এ অঞ্চলের (উয়ারি-বটেশ্বর) সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে রুলেটেড মৃৎপাত্র, পাড়মৃৎপাত্র, স্যান্ডউইচ ধাঁচের পুতি, উচ্চ মাত্রায় টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ পাওয়া গেছে। ড. অতুল সুর লিখেছেন, 'গ্রিক রোমান ও মিশরীয় সূত্র থেকে আমরা মাত্র এইটুকু জানতে পারি যে, গঙ্গারিডি রাষ্ট্র গঙ্গানদীর মোহনা দেশে অবস্থিত ছিল এবং ওই রাষ্ট্রের প্রধান বন্দরের নাম ছিল 'গাঙ্গে’।’ তার মানে গঙ্গারিডি রাষ্ট্র যে বাংলায় ছিল, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও ভারতীয় সাহিত্যে গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের কোনো উল্লেখ নেই, তবুও যারা বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করত তারা, তাই গঙ্গারিডির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হবার কোনো কারণ নেই। গ্রিক ঐতিহাসিক ডিওডোরাস সিকুলাস লিখেছেন, সমুদ্রের মোহনায় গঙ্গা সেখানে আত্মবিসর্জন দেয় সেটা গঙ্গারিডাই রাজ্যের পূর্বসীমা।' রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি লিখেছেন, ‘গঙ্গার অন্তিম প্রবাহ' 'গঙ্গারিডেস' দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। পক্ষান্তরে প্রাচীন বাংলায় উয়ারী-বটেশ্বর-এর অবস্থান নরসিংনদীর পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ ও আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে। যেখানে হাজার বছরের প্রাচীন এক দুর্গনগরী আবিষ্কৃত হয়েছে। যাই হোক উয়ারী-বটেশ্বর সভ্যতার সঙ্গে প্রাচীন বাংলার গঙ্গাঋদ্ধি রাষ্ট্রের সম্পর্কটির বিষয়টা সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কেননা, কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই দাবি করেন যে, প্রাচীন বাংলার গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যেই প্রাচীন বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাষ্ট্র। 


প্রশ্ন : গঙ্গারিডাই সভ্যতা সম্পর্কে বর্ণনা করুন?

গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল গঙ্গা তীরবর্তী গঙ্গে। এই গঙ্গে নগরী ছিল একটি প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক বন্দর। গঙ্গে বন্দরের সঙ্গে রোম, মিশর, চীন, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার তেজারতি সম্পর্ক ছিল। এখানে বাণিজ্য বন্দরে বিভিন্ন দেশের জাহাজ যাতায়াত করত। এখান থেকে স্বর্ণ ও মনিমুক্তা, রেশম ও কার্পাসজাত বস্ত্র, মশলা, গন্ধদ্রব্য এবং যুদ্ধোপকরণ হিসেবে হাতি প্রভৃতি বিদেশে রফতানি হত। [মনসুর মুসা সম্পাদিত বাঙলাদেশ, পৃষ্ঠা 30] গ্রিক ভৌগোলিক টলেমি দ্বিতীয় শতকে জানান, গংগা মোহনার সব অঞ্চলজুড়েই গঙ্গারিডিরা বাস করে। তাদের রাজধানী গংগ খ্যাতিসম্পন্ন এক আন্তর্জাতিক বন্দর। এখানকার তৈরি মসলিন ও প্রবাল রত্নাদি পশ্চিম দেশে রফতানি হয়। তাদের মতো পরাক্রান্ত ও সমৃদ্ধ জাতি ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই। গঙ্গারিডি বা গঙ্গা রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল বারোবাজার। তখন এই বারোবাজারের নাম ছিল গঙ্গে বা গঙ্গারোজিয়া। উপমহাদেশের মধ্যে একটি প্রাচীন বাণিজ্য বন্দর হিসেবে এর নাম সুবিদিত ছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক এ. এফ. এম আব্দুল জলীল বলেন, 'মুরলি বা যশোর টলেমি বর্ণিত গঙ্গা রেজিয়া।' [এ. এফ. এম আব্দুল জলীল : সুন্দরবনের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৫৫৭] শ্রীযুক্ত পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও এই গঙ্গারেজিয়া যশোহর জেলার অন্তর্গত বলে অনুমান করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক। গাঙ্গেয় অববাহিকার এক পরাক্রমশালী রাষ্ট্র। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলজুড়ে এ স্বাধীন রাষ্ট্রটির অবস্থান। আজাদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করত এক জাতি; যাদের ভয়ে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সৈন্যসামন্ত গুটিয়ে পালিয়েছিলেন ভারতবর্ষ ও পূর্ব এশিয়া জয়ের নেশা ছেড়ে। সেই ঐতিহাসিক কোটালিপাড়া প্রাচীন এ জনপদকে গঙ্গারিডির রাজধানী বলে অভিহিত করেছেন সমৃদ্ধশালী সুপারপাওয়ার রাষ্ট্রটির নাম ছিল গঙ্গারিডি। গঙ্গারিডির সুনাম সুখ্যাতি তখন ঐতিহাসিকদের একাংশ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে গ্রিক বিবরণে দেখা যায়, গঙ্গার মোহনায় তুঙ্গে। সমসাময়িক গ্রিক ও লাতিন পর্যটক, ভূগোলবিদ ও মুসাফিরদের কলমে এ জাতির গঙ্গারিডি রাষ্ট্র। গঙ্গা নদীর মোহনায় কুমারতালক বা কোটালিপাড়ায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের শৌর্যবীর্য ও জ্ঞানগরিমার সপ্রশংস চিত্র আমাদের গৌরবান্বিত করে। গঙ্গারিড, রাজধানী। মি. ওয়াটার্স ও জেমস ওয়াইজের মতে, কোটালিপাড়ায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিড়ি, গঙ্গাহৃদি, গঙ্গাহৃদয়, গঙ্গাঋদ্ধি, গঙ্গারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজধানী ছিল। মেগাস্থিনিসের বিবরণে দেখা যায়, গঙ্গার মোহনায় মোদকলিঙ্গ নামে গঙ্গারিডির লিপ্যান্তর। মেগাস্থিনিসের গঙ্গারিডি আর প্লিনির বঙ্গরাষ্ট্র একই ভূখণ্ডের একটি দ্বীপ ছিল এবং সেখানে মোলঙ্গিদের আবাস ছিল। গৌরনদী উপজেলার মেদাকুল দুটি ভিন্ন নাম। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্ডারের উপমহাদেশে অভিযানের সময়েও গ্রাম প্রাচীনকালের মোদকলিঙ্গের পরিবর্তিত নাম। ১৮৭৩ সন পর্যন্ত কোটালিপাড়া থানা বাংলার অধিবাসীরা শৌর্যবীর্য, সভ্যতা ও কৃষ্টিতে শীর্ষস্থানীয় ছিল। বহুজাতির বাকেরগঞ্জ জেলাধীন ছিল। উল্লেখ্য, বর্তমানে বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলা আবাসভূমি এ উপমহাদেশে গঙ্গা-বিধৌত গঙ্গারিডি জাতিই ছিল শ্রেষ্ঠ। কার্ডিয়াস, সীমানা থেকে কোটালিপাড়ার দূরত্ব মাত্র পাঁচ-ছয় মাইল। [সিরাজ উদ্দীন আগ্বেদ ডিওডোরাস, প্লুতার্ক প্রমুখ গ্রিক লেখকের ইতিবৃত্ত, স্ট্রাবো ও টলেমির ভৌগোলিক বৃত্তান্ত বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৫) আর ভার্জিলের মহাকাব্য থেকে এ সময়কার বাংলার অধিবাসীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রমাণ পাওয়া যায়।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগনা জেলার প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড় সম্ভবত প্রাচীন বন্দর-রাজ্য ‘গঙ্গারিডাই'র রাজধানী বা 'গাঙ্গে বন্দর। হয়েছে এবং গঙ্গা নামে মোহনায় একটি বন্দর ছিল। বন্দরের বিপরীত দিকে ছিল একটি দ্বীপ। 

প্রশ্ন : গুপ্ত শাসনের পূর্বে বাংলার অবস্থা কেমন ছিল?

উত্তর : গুপ্ত যুগের পূর্বে প্রাচীন বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করার তেমন কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। কেননা তখনকার মানুষ আজকের মতো ইতিহাস লেখায় অভ্যস্ত ছিল না। ভারতীয় এবং বিদেশি সাহিত্যে এ সময়কার বাংলা সম্পর্কে ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত উক্তি থেকে আমরা ইতিহাসের অল্পস্বল্প উপাদান পাই। এ সকল বিচ্ছিন্ন ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে সন-তারিখ ও প্রকৃত ঘটনা সংবলিত ধারাবাহিক কোনো ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বস্তুত ৩২৭-২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় থেকে প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যায়। গ্রিক লেখকদের কথায় তখন বাংলাদেশে 'গঙ্গারিডাই' নামে এক শক্তিশালী রাজ্য ছিল। গঙ্গা নদীর যে দুটি স্রোত এখন ভাগীরথী ও পদ্মা বলে প্রশ্ন : গিল্ডের যিনি সঠিক আচরণের নিয়ম তৈরি করেন তাদেরকে কী বলা হয় পরিচিত—এ উভয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলেই ‘গঙ্গারিডাই' জাতির বাসস্থান ছিল। 

প্রশ্ন : কোটিবর্ষ কী ?

উত্তর : কোটিবর্ষ ছিল বাংলার এক প্রাচীন শহর এবং কোটিবর্ষ বিষয়ের (আঙ্গুলি একসঙ্গে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। এও অনুমান করা যেতে পারে, বিভাগ) প্রশাসনিক কেন্দ্র।

প্রশ্ন : গুপ্ত শাসনকালে বাংলা অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করুন?

উত্তর : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে গুপ্ত শাসন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খ্রিস্টীয় তিন শতকের শেষ এবং চার শতকের প্রথম দিকে সম্ভবত প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা সমুদ্রগুপ্তের মাধ্যমে বাংলায় গুপ্ত শাসন সম্প্রসারিত হয়। শিলালিপি, প্রশস্তিলিপি, তাম্রশাসন, মুদ্রা, সাহিত্যিক উপকরণ এবং বিদেশিদের বর্ণনা থেকে বাংলায় গুপ্ত শাসন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত শাসনামলে বাংলায় কতকগুলি প্রশাসনিক স্তর ছিল, যেমন 'ভুক্তি', 'বিষয়', ‘মণ্ডল’, ‘বীথি' ও ‘গ্রাম’। এ সকল প্রশাসনিক স্তরের প্রত্যেকটির প্রধান কেন্দ্রে একটি করে ‘অধিকরণ' (অধিষ্ঠান) ছিল। 'ভুক্তি' ছিল সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক ইউনিট। সমসাময়িক লিপিমালায় ‘পুণ্ড্রবর্ধন' (সমগ্র উত্তরবঙ্গ) এবং 'বর্ধমান' (প্রাচীন রাঢ়ের দক্ষিণাংশ) নামে দুটি ভুক্তি ছিল বলে জানা যায়। রাজার একজন ডেপুটি ভুক্তি শাসন করতেন। 'ভুক্তি' প্রশাসককে উপারিক’ বা উপারিক মহারাজ' বলা হতো। ‘বিষয়' ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট। ‘বিষয় প্রশাসকের উপাধি ছিল 'কুমারমাত্য' এবং 'আযুক্তক’। লিপিমালা থেকে ‘কোটিবর্ষ বিষয়', 'পঞ্চনগরী বিষয়', 'বরাকমণ্ডল বিষয়' ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়। বিষয়াধিকরণে ‘পুস্তপাল' (দলিল রক্ষক) নামে এক শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। ‘কোটিবর্ষ বিষয়'-এর বিষয়পতির সহায়ক রূপে এক উপদেষ্টামণ্ডলীর কথা জানা যায় ২, ৪ ও ৫ নং দামোদরপুর তাম্রশাসন থেকে। সেকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী চারজন সদস্য ও স্বয়ং বিষয়পতির সমন্বয়ে এ উপদেষ্টামণ্ডলী গঠিত হতো। এ উপদেষ্টা সভার সদস্যগণ ছিলেন 'নগর শ্রেষ্ঠী' (শহরের বিভিন্ন গিল্ড বা কর্পোরেশনের বা ধনী ব্যাংকারদের সংস্থার সভাপতি), 'প্রথম সার্থবাহ' (প্রধান ব্যবসায়ী), 'প্রথম কুলিক' (প্রধান কারিগর) এবং 'প্রথম কায়স্থ (প্রধান করণিক বা আধুনিক কালের অফিস সচিব ধরনের রাষ্ট্রীয় কর্মচারী অথবা কায়স্থ শ্রেণির প্রতিনিধি)। এভাবে প্রশাসনে পরিষদ গঠিত হতো। সব থেকে ছোটো প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ছিল 'গ্রাম'। 'গ্রামিক', ব্রাহ্মণ', 'মহত্তর', 'কুটুম্বী' প্রমুখ গ্রাম প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। 

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার শিল্পকলা সম্পর্কে আলোচনা করুন?

উত্তর : প্রাচীন বাংলার শিল্পকলার ক্ষেত্রে পাল যুগ স্মরণীয়। নবম থেকে দ্বাদশ শতক-এ চার শতক পর্যন্ত এ যুগের শিল্পকে সাধারণত; পাল যুগের শিল্পকলা বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, এ যুগের শিল্পনীতিই পরবর্তী সেন যুগেও অব্যাহত ছিল। প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত দেব-দেবীর মূর্তি এ যুগের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। এতে ধর্মভাবের প্রভাবই ছিল বেশি। শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুসারে দেব-দেবীর মূর্তিগুলো নির্মিত হয়েছিল। তথাপি শিল্পীর শিল্পকৌশল ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় এতে লক্ষ করা যায়। মূর্তি নির্মাণে সাধারণত অষ্টধাতু ও কালো কষ্টিপাথর ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া স্বর্ণ ও রূপার ব্যবহারের প্রচলন ছিল। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাল সম্রাটরা বাংলায় স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। পূর্বতন বঙ্গীয় সভ্যতাকে তাঁরা উন্নত করে তোলেন। সেই সঙ্গে শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অসামান্য কীর্তি রেখে যান। তারা বাংলা ভাষার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। পাল যুগের পূর্বেকার কোনো চিত্র আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রাচীনকালেই বাংলায় যে চিত্র অঙ্কনের চর্চা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণত বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের দেওয়াল সৌন্দর্যময় করার জন্য চিত্রাঙ্কন করার রীতি প্রচলিত ছিল। তখনকার দিনে বৌদ্ধ লেখকেরা তালপত্র অথবা কাগজে তাদের পুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেন। এ সকল পুঁথি চিত্রায়িত করার জন্য লেখক ও শিল্পীরা ছোট ছোট ছবি আঁকতেন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনেও প্রাচীন বাংলার শিল্পীরা যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। রাজা রামপালের রাজত্বকালে রচিত 'অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' পুঁথি বাংলার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। রেখার সাহায্যে চিত্রাঙ্কনের আর একটি দৃষ্টান্ত হল সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডোম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পিঠে উৎকীর্ণ বিন্নুর রেখাচিত্র।


প্রশ্ন : গুপ্ত শাসনকালে বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন ছিল? 

উত্তর : গুপ্ত শাসনকালে বাংলায় কতকগুলি প্রশাসনিক স্তর ছিল যেমন 'ভুক্তি', 'বিষয়', মণ্ডল', 'বীথি' ও 'গ্রাম'। এ সকল প্রশাসনিক স্তরের প্রত্যেকটির প্রধান কেন্দ্রে একটি করে অধিকরণ” (অধিষ্ঠান) ছিল। 'ভুক্তি' ছিল সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক ইউনিট। সমসাময়িক লিপিমালায় পুণ্ড্রবর্ধন' (সমগ্র উত্তরবঙ্গ) এবং 'বর্ধমান' (প্রাচীন রাঢ়ের দক্ষিণাংশ) নামে দুটি ভুক্তি ছিল বলে জানা যায়। রাজার একজন ডেপুটি ভুক্তি শাসন করতেন। 'ভুক্তি' প্রশাসককে উপারিক' বা ‘উপারিক মহারাজ' বলা হতো। বিষয় ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট। ‘বিষয়” প্রশাসকের উপাধি ছিল 'কুমারমাতা' এবং "আযুক্তক"। লিপিমালা থেকে ‘কোটিবর্ষ বিষয়', 'পঞ্চনগরী বিষয়', 'বরাকমণ্ডল বিষয়’ ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়। বিষয়াধিকরণে 'পুস্তগাল' (দলিল রক্ষক) নামে এক শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। "কোটিবর্ষ বিষয়-এর বিষয়পতির সহায়ক রূপে এক উপদেষ্টামণ্ডলীর কথা জানা যায় ২. ৪ ও ৫ নং দামোদরপুর তাম্রশাসন থেকে। সেকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী চারজন সদস্য ও স্বয়ং বিষয়পতির সমন্বয়ে এ উপদেষ্টামণ্ডলী গঠিত হতো। এ উপদেষ্টা সভার সদস্যগণ ছিলেন নগর শ্রেষ্ঠী (শহরের বিভিন্ন গিল্ড বা কর্পোরেশনের বা ধনী ব্যাংকারদের সংস্থার সভাপতি), 'প্রথম সার্থবাহ' (প্রধান ব্যবসায়ী), "প্রথম কুলিক' (প্রধান কারিগর) এবং 'প্রথম কায়স্থ (প্রধান করণিক বা আধুনিক কালের অফিস সচিব ধরনের রাষ্ট্রীয় কর্মচারী অথবা কায়স্থ শ্রেণির প্রতিনিধি)। এভাবে প্রশাসনে স্থানীয় জনগণের সংযোগ বা অংশগ্রহণ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, স্থানীয় প্রশাসনে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির চর্চা হতো। বাংলায় স্থানীয় শাসনের সর্বপ্রাচীন নজির হিসেবেও গুপ্ত শাসনের কথা বলা যেতে পারে। বিষয় -এর পরবর্তী প্রশাসনিক ইউনিট বীথি। বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত 'বকটক বীথি এবং পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্গত • দক্ষিণাংশক বীথি' তাম্রশাসনে প্রাপ্ত দুটি বীথির নাম। তাম্রশাসনে বীথ্যধিকরণের উল্লেখ থাকলেও এর গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। সম্ভবত 'মহত্তর', 'অগ্রহরীণ', 'খড়গী', 'বহনায়ক' প্রমুখ মিলে বীথির উপদেষ্টা বাংলার প্রাথমিক ইতিহাস ৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরিষদ গঠিত হতো। সব থেকে ছোটো প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ছিল 'গ্রাম'। 'গ্রামিক', ‘ব্রাহ্মণ', 'মহত্তর', 'কুটুম্বী' প্রমুখ গ্রাম প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।গুপ্ত যুগের ভূমি ব্যবস্থাও ছিল সুনিয়ন্ত্রিত। খিল' (পতিত জমি), 'ক্ষেত্রে (চাষযোগ্য), 'বাল্ড' (বসবাসের উপযোগী) ভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগে ভূমির যথার্থ পরিমাপের ব্যবস্থা ছিল। 'কূল্যবাপ' ও 'স্লোণবাপ' ছিল পরিমাপের একক। এ ছাড়াও 'পাটক', 'ভূ-পাটক', 'আটক', 'কাকিনি', 'খাদিক', 'হাল', 'প্রোগ' ইত্যাদিও পরিমাপের একক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত যুগ সামগ্রিকভাবে 'স্বর্ণযুগ' হিসেবে খ্যাত। এ সময়ে প্রজাহিতৈষী কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় যে শান্তি, সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রকাশ ঘটে, সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলা তার সুফল ভোগ করে। বাংলা সর্বভারতীয় বাণিজ্যেরও অংশীদার হয়। গুপ্ত যুগে বাংলায় স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সর্বব্যাপী প্রচলন হয়। স্বর্ণমুদ্রার বহুল প্রচলন বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধির পরিচায়ক। সুপারি, রেশম, তুলা, নারকেল, লবণ, চিনি ইত্যাদি বাংলা থেকে রপ্তানি হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে এ সময় বাংলার ছিল বাণিজ্যিক সংযোগ। বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণে গুপ্ত-অনুকরণ মুদ্রা পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় বাংলা মুদ্রা অর্থনীতির সুফল ভোগ করেছে।

প্রশ্ন : ইতিহাসের সঙ্গে ভূগোলের সম্পর্ক কী ?

উত্তর : ইতিহাস এবং ভূগোল খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত একটি বিষয়। ভূগোল হল একটি আঞ্চলিক বিজ্ঞান যেখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু, ভূমি, মহাসাগর বায়ুমণ্ডল থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে আলোচিত হয়। অন্যদিকে ইতিহাস হল লিখিত নথির সাহায্য অতীতের অধ্যায়ন। প্রত্যেক দেশের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বহুল পরিমাণে সেই দেশের ভৌগোলিক পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই কারণেই হয়তো প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাকে 'নীল নদের দান' অথবা ভারতবর্ষকে 'হিমালয়ের দান' বলা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সঙ্গে ভৌগোলিক যোগসূত্র রয়েছে। পর্বত সংলগ্ন পরিবেশের জন্য প্রাচীন গ্রিসে যেমন প্রচুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, একইভাবে সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ার জন্যে দেশটির অধিবাসীরা সামুদ্রিক বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারে বিশেষ পটু এবং তৎপর হয়েছে। ইংল্যান্ডের বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারের মূলেও ছিল তার ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব। প্রাচীন সুমেরীয় ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে চাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর গুরুত্ব ছিল যেমন অপরিসীম তেমনি পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে স্থায়ী বসতি স্থাপনের মূলেও ছিল সিন্ধু বিধৌত অঞ্চলের প্রত্যক্ষ প্রভাব। বিশেষ করে মানব ভূগোল আখ্যায়ন করার সময়ে কালগুলির পরিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে এবং অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতিগুলির মধ্যে তুলনা করার জন্যে একটি সময়ের সাথে মানবসমাজ ও প্রকৃতির মধ্যে মিথোস্ক্রিয়া পরিবর্তন ও ভৌত কারণগুলির পরিবর্তন বোঝার জন্য আমাদের প্রতিবার অতীতের সময় কালযুগের উল্লেখ করতে হয়। জলবায়ু, নদীর গতিপথ, ক্ষয়জনিত ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদির মতো পরিস্থিতি বোঝার জন্যেও ইতিহাস অপরিহার্য। অনেক ঐতিহাসিক অমাদের অতীত বন্যার ঘটনা, প্রাচীন সময়ের খরা এবং অতীতের জলবায়ু সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি তথ্য প্রদান করে। শুধু ভূগোলের ক্ষেত্রেই নয়, ইতিহাস অধ্যায়নের জন্যে 'মানচিত্র' একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান। অতীতে সমস্যার সম্পসারণ এবং সংকোচন প্রাচীন সভ্যতার সীমা, অতীতের মানব অভিবাসনের পথ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধের অধ্যায়ন এবং আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও ঘটনা মানচিত্র ব্যবহার করে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায়। ফরাসি দার্শনিক গাঁ বোডিন এক জায়গায় মন্তব্য করেছেন যে, 'ভূগোল ও আবহাওয়া বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে' বলাবাহুল্য ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

প্রশ্ন : বাংলাকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন ?

উত্তর : সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মনীষীদের লেখনীতে নদ-নদীর স্তুতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে নদীর ভূমিকার দিকটি বিবেচনা করে ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট সান্ড্রা পোস্টাল বলেছেন- মানবসভ্যতার ইতিহাসে পানির (নদী ও সাগর) অবদান ছাড়া আলোচনা করা অসম্ভব। বস্তুত নদীর অবদানেই প্রাণ পেয়েছে মানবসভ্যতা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা যেমন- অ্যাসেরীয়, ক্যালডীয়, সিন্ধু, চৈনিক প্রভৃতি থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সভ্যতাগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। প্রাচীন বাংলার ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। বলা হয় তেরো শত নদীর দেশ বাংলাদেশ। হাজারও নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে পুরো দেশজুড়ে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এগুলির মধ্যে প্রধান। এছাড়া তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, মধুমতী, করতোয়া, কর্ণফুলি, গড়াইসহ প্রভৃতি অসংখ্য ছোটো বড়ো নদী আছে এদেশে। প্রতিটি নদীরই রয়েছে স্বাতন্ত্রতা। বাংলার জনপদগুলোকে গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছে এসব নদী। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় রূপময়তার বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছে নদী। আবহমান কাল ধরেই নদীর প্রভাব বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। অস্ট্রিক জাতির লোকেরা পূর্ব ও মধ্য ভারতে প্রথম কৃষিচাষ শুরু করে। এর উপর ভিত্তি করেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সুসভ্য জীবনের সুত্রপাত করে। তারা ধান, পাট, কলা ও নারকেল চাষ করত যা আজও বাংলার সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ সব কিছুর মূলেই রয়েছে নদীর অবদান। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নদীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাংলার মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। পানীয় জলের সবচেয়ে বড়ো উৎস নদী। নদী থেকে প্লাবনের সাথে ভেসে আসা পলিমাটি এদেশের মাটিকে উর্বর করে শস্যশ্যামলা করেছে। আবার নদীগুলি থেকে যে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় তা আমিষের চাহিদা পুরণের পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করেছে। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সংস্কৃতিকে যদি সমাজের প্রতিচ্ছবি ধরা হয় তা হলে সমাজের যত বিষয় রয়েছে-এর প্রায় সবকিছুই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এদেশের যে সংস্কৃতি নানা ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে তা প্রধানত কৃষিজীবি সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে যার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে নদী। নদীকেন্দ্রিক জীবন সংস্কৃতির কারণেই এদেশে ভাটিয়ালি ও সারি গানের বিপুল সম্ভার গড়ে উঠেছে। এছাড়া বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ পোশাক পরিচ্ছদও বহুলাংশে নদী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। শরীরের রক্তধারার মতোই যেন বাংলাদেশের নদী এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সুজলা সুফলা, শস্যশ্যামলা করে তুলেছে এদেশকে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অনেক নদী হারিয়েছ তার যৌবন। অনেক নদীই আজ লুপ্তপ্রায়। অথচ একসময় নদী তীরবর্তী সভ্যতা হিসেবেই এদেশে জনপদ গড়ে উঠেছিল। কালের নিয়মে নদীগুলি তার পূর্বের জৌলুস হারালেও প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি সেগুলি নানাভাবে এদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। আর তাই নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন : ভূ-প্রকৃতি ও মৃত্তিকার ধর্ম অনুসারে বাংলার মৃত্তিকার শ্রেণি বিভাজন করুন? 

উত্তর : নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ অঞ্চল। এর উপর দিয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রষ্মপুত্র, কর্ণফুলি প্রভৃতির মতো অসংখ্য ছোটো বড়ো নদী প্রবাহমান। বাংলাদেশের ভূমি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু। ফলে উক্ত নদনদী এবং এদের শাখানদী ও উপনদীগুলোও উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রবাহিত হয়। এ দেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাহাড়ি এলাকা ব্যতীত প্রায় সমগ্র এলাকাই এই সমস্ত নদ-নদী বাহিত পললে গঠিত। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভূ-প্রকৃতি মৃত্তিকার গঠন ও রাসায়নিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে Brammer (ব্রামার) বাংলাদেশের মাটিকে মোট ৫টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। (১) পাহাড়ি মৃত্তিকা, (২) ল্যাটোসোলিক/লোহিত/সোপাল মৃত্তিকা, (৩) পল্ল/পাললিক/প্লাবন সমভূমির মৃত্তিকা, (৪) জলাভূমির মৃত্তিকা ও (৫) কোষ মৃত্তিকা।

(১) পাহাড়ি মৃত্তিকা : বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম সিলেটের পাহাড়সমূহে এই ধরনের মৃত্তিকা দেখা যায়। এই মাটি টার্সিয়ারি মহাকালের বেলেপাথর ও কাদাপাথর দ্বারা গঠিত। এই মাটির রং ধূসর বা ধূসর বাদামী। এই মাটির অঞ্চলের আয়তন আনুমানিক ১৮,৫১০ বর্গকিমি। এই সকল পাহাড়ি অঞ্চলে ২৫৪০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এবং যার কারণেই এখানকার শিলাসমূহ খুব সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মৃত্তিকা গঠন করে। এই মাটি পুষ্টি সাধনকারী উপাদানের সংস্পর্শে আসতে পারে না বলে কম উর্বর এবং অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে অম্লধর্মী। এসব এলাকায় প্রধানত ঝুম চাষ পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হয়।

(২) ল্যাটোসোলিক/লোহিত/ সোপান মৃত্তিকা : প্রায় ১১০৯৬ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই মৃত্তিকা। প্লাইস্টোসিন কালের সোপানসমূহ হতে উদ্ভূত। লালচে বাদামি রং-এর এই মৃত্তিকা বরেন্দ্রভূমিতে ‘খিরাড়' বা 'খিয়ার' নামে পরিচিত। শুষ্ক আবহাওয়ায় এ মাটি পাথরের মতো শক্ত ও কঠিন হয়ে যায়। এ মাটিতে চুন, জৈব পদার্থের পরিমাণ কম এবং লৌহ এবং অ্যালমুনিয়াম অক্সাইডের পরিমাণ বেশি থাকায় অম্লধর্মী যার উর্বরতা অত্যন্ত কম এবং চাষাবাদে অনুপযোগী। মাটির গঠন এবং রাসায়নিক উপাদানের ভিত্তিতে লোহিত মৃত্তিকাকে নিম্নলিখিত উপবিভাগে বিভক্ত করা হয় যথা— অগভীর লোহিত পিঙ্গল সোপান মৃত্তিকা, গভীর লোহিত পিঙ্গল সোপান মৃত্তিকা, কর্পূ পিঙ্গল সোপান মৃত্তিকা এবং ধূসর সোপান মৃত্তিকা।

(৩) পল্ল বা পাললিক বা প্লাবন সমভূমি মৃত্তিকা : নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত প্লাবন ভূমিতে পলল মৃত্তিকা দেখা যায়। গঙ্গা, যমুনা, তিস্তা এবং মেঘনা নদীর প্লাবন সমভূমি এই ধরনের মৃত্তিকা দিয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল এই মাটি দ্বারা গঠিত। এই মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি। গাঠনিক এবং রাসায়নিক স্বাতন্ত্র অনুসারে পল্ল মাটি নিম্নোক্ত উপশ্রেণিতে ভাগ করা হয়। 

(১) চুন বিহীন পলিমৃত্তিকা, 

(২) চুন্নুক্ত পলিমৃত্তিকা 

(৩) অম্লগন্ধ পাললিক মৃত্তিকা 

(৪) পীট মৃত্তিকা 

(৫) প্লাবন সমভূমির চুনবিহীন গাঢ় ধূসর মৃত্তিকা 

(৬) পর্বত পাদদেশ ধূসর মৃত্তিকা, 

(৭) অববাহিকার অম্লকর্দন মৃত্তিকা 

(৮) প্লাবন সমভূমির চুনবিহীন গাঢ় ধূসর মৃত্তিকা 

(৯) প্লাবন সমভূমির চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর মৃত্তিকা, 

(১০) প্লাবন সমভূমির চুনবিহীন পিঙ্গাল মৃত্তিকা, 

(১১) প্লাবন সমভূমির চুনযুক্ত পিঙ্গল মৃত্তিকা, 

(১২) তরাই এলাকার কৃষ্ণ মৃত্তিকা।

(৪) জলাভূমি মৃত্তিকা : স্রোতজ জলমগ্ন সমভূমি এলাকায় এ মাটি বিদ্যমান। খুলনার সুন্দরবন এলাকার এই মাটি প্রধানত কাদামাটি। তবে সমুদ্র জোয়ারভাটার প্রভাবে এই মাটি লবণারধর্মী।

(৫) কোষ ধর্মী : অত্যাধিক অম্লযুক্ত বাদামি বা হলদে বর্ণের চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলের জলমগ্ন মাটিকে স্থানীয়ভাবে 'কোষ' মৃত্তিকা বলে। এ মাটি সাধারণত চাষবাদের অনুপযোগী। ফসফেট বা চুন ব্যবহার করে এই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে হয়। 

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার নদ-নদী সম্পর্কে আলোচনা করুন? 

উত্তর : বাংলা একটি নদীপ্রধান দেশ। প্রাচীনকাল থেকেই অসংখ্য নদ-নদী জালের আকারে ছড়িয়ে থাকার কারণে পরিচিতি পেয়েছে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। এখানকার নদ-নদীর বাহুল্য যেমন এদেশের ভূমিকে উর্বর ও শস্যশালিনী করেছে, তেমনি নদ-নদীর গতিপরিবর্তন এখানকার নগরীর অবক্ষয় ও বিলুপ্তিরও কারণ হয়ে উঠেছে। এখানকার প্রধান নদী গঙ্গা। রাজমহল পাহাড়ের উত্তর পশ্চিম অংশের তেলিয়াগড় ও সকরিগলির খাত অতিক্রম করে গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে গঙ্গার একটি ধারা দক্ষিণদিকে ও অপরধারা দক্ষিণ পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। দক্ষিণ ধারাটা একসময় গৌড় নগরের উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হত। গৌড় তখন গঙ্গার দক্ষিণতীরে অবস্থিত ছিল। পরবর্তীকালে নদীর গতি ক্রমশ দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে সরে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে, প্রাচীন গৌড়ের পঁচিশ মাইল দক্ষিণে গঙ্গা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ দিকের শাখাটির নাম হয় ভাগীরথী আর দক্ষিণ পূর্বের শাখাটির নাম হয় পদ্মা। ভাগীরথীর প্রবাহ আরও দক্ষিণে এসে হুগলি নামে পরিচিত হয়েছে। পশ্চিমদিক থেকে বাঁশলোই, মোর, অজয় নদের স্রোত এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে। হুগলির কাছে ত্রিবেণীতে ভাগীরথীর সঙ্গে তার দুটি শাখানদী সরস্বতী ও যমুনা এসে মিশেছে। সরস্বতী প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণ পশ্চিমে, যমুনা দক্ষিণ পূর্বে, মূল ভাগীরথীর স্রোতটি দক্ষিণদিক বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। হুগলি নামে পরিচিত এই প্রবাহটি কলকাতা পর্যন্ত এসে তারপর আদিগঙ্গা নামে সমুদ্রে মিশেছে। পদ্মা নামে গঙ্গার যে দক্ষিণ-পূর্বমুখী প্রবাহটি তার গতিপথ বারেবারেই পরিবর্তিত হয়েছে। অনুমিত হয়, প্রথমদিকে এই নদীস্রোত রামপুর বোয়ালিয়া হয়ে চলনবিলের মধ্য দিয়ে এবং ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী ও বুড়ীগঙ্গা হয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পড়ত। আঠারো শতকে পদ্মার নিম্নাংশ আরও দক্ষিণে ছিল। পদ্মা ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণে মেঘনার মোহনায় পড়েছে। কালিগঙ্গা নামে একটি নদীর মাধ্যমে পদ্মা মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ঐ স্রোতেই পদ্মা প্রবাহিত হত তার নাম ছিল কীর্তিনাশা। গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা ব্রষ্মপুত্রের প্রধান শাখা যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বরিশাল ও নোয়াখালি জেলার ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ ও কাঁসাই। এই নদীগুলি ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে নির্গত হয়ে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে। উত্তরবঙ্গের নদীগুলি কোনোটি গঙ্গা আবার কোনোটি ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিশেছে। উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীটির মূল নাম ছিল ত্রিস্রোতা। করতোয়া, পুনর্ভবা ও আত্রাই এই তিনটি স্রোতের সমাহার ছিল। করতোয়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরী। ১৭৮৭ সালের দিকে তিস্তা তার পুরোনো গতি পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়।  একসময় কোশী ও মহানন্দা করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে উত্তরের কোচ, কিরাত প্রভৃতি আদিবাসীদের থেকে দক্ষিণের জাতিগুলিকে স্বতন্ত্র করেছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর গতি পরিবর্তন বাংলাদেশের ভাগ্যবিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। তাম্রলিপ্তি ও সপ্তগ্রামের মতো বন্দর নগরীগুলির উত্থানপতন নদীর গতিপথের উপর নির্ভর করেছে। গৌড় নগরীর পতন, কোটালিপাড়ার অবক্ষয়, যশোহর খুলনার আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এই নদ-নদীর গতিপরিবর্তনের অনিবার্য পরিণাম।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করুন?

উত্তর : বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলি এদেশের ইতিহাসকে যুগযুগ ধরে প্রভাবিত করেছে। প্রথমেই বাংলা বলতে কোন ভূখণ্ডকে বোঝাতো তা স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন। মোটামুটিভাবে ১৯৪৭ সালের পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের 'বোল' প্রদেশের ভূখণ্ডকেই 'বাংলা' অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়েছে। বর্তমানে এই ভূখণ্ডেই আমাদের বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ। ইতিহাসের দৃষ্টিতে এই ভূখণ্ডের একটি আঞ্চলিক সত্তা ছিল এবং ভূগোলবিদগণ উপমহাদেশের মধ্যে 'বাংলা'কে একটি ভৌগোলিক ‘অঞ্চল' বলে স্বীকার করেছেন। প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত এক বিশাল সমভূমি এই বাংলা। এর পূর্বে ত্রিপুরা, গারো ও লুসাই পাহাড়, উত্তরে শিলং মালভূমি ও নেপালের তরাই অঞ্চল, পশ্চিমে রাজমহল ও ছোটোনাগপুর পর্বতরাজির উচ্চ ভূমি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই বিস্তৃত সমভূমির দক্ষিণ দিক সাগরাভিমুখে ঢালু এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার জলরাশি দ্বারা বয়ে আনা বিপুল পরিমাণ পলি সাগরে উৎসারিত হচ্ছে। সমুদ্রোপকূলবর্তী নিম্নভূমি জঙ্গলাকীর্ণ। এর পেছনেই অর্থাৎ উত্তরে প্রায় ৫০ হাজার বর্গমাইল সমতল ভূমি, যার গঠনে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা প্রবাহের অবদান রয়েছে। এই বিস্তৃত সমতলভূমির মধ্যে ত্রিপুরা অঞ্চল নিকটবর্তী প্লাবন ভূমির তুলনায় গড়ে ৬ ফুট উঁচু এবং এর মাঝামাঝি রয়েছে লালমাই পাহাড়। সিলেট এলাকাও গড়ে প্রায় ১০ ফুট উঁচু এবং এরই দক্ষিণ সীমায় অবস্থিত প্লাইস্টোসিন যুগের সুগঠিত মধুপুর উচ্চভূমি। এই সুগঠিত উচ্চভূমির উত্তর-পশ্চিমে বিস্তৃতিই হচ্ছে “বরেন্দ্র' বা 'বারিন্দ্র এলাকা। পশ্চিমে রাজমহল ও ছোটনাগপুর পাহাড় সংলগ্ন উত্তর থেকে দক্ষিণাভিমুখে বিস্তৃত প্লাইস্টোসিন ভূ-ভাগ রয়েছে। নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায় “একদিকে সুউচ্চ পর্বত, দুই দিকে কঠিন শৈলভূমি, আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য ইহাই বাঙালীর ভৌগোলিক ভাগ্য।” সামগ্রিকভাবে ভূ-প্রাকৃতিক গঠন বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে- 

১. উত্তর বাংলার পাললিক সমভূমি, 

২. ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অন্তবর্তী ভূ-ভাগ, 

৩. ভাগীরথী-মেঘনা অন্তর্বর্তী ব-দ্বীপ, 

৪. চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা, 

৫. বর্ধমান অঞ্চলের অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা।

অবস্থানগত বিবেচনায় বাংলা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপূর্ব প্রান্তের অঞ্চল। বাংলার উত্তরে প্রকাণ্ড হিমালয় পর্বত ও নেপাল। পূর্বে মনিপুর, আসাম, ত্রিপুরা ও মায়ানমার। পশ্চিমে ভারতের বিহার এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নদীমালার। প্রধান নদীগুলোর স্রোতধারাই বাংলাকে মূলত চারটি ভাগে বিভক্ত করেছে উত্তর, পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব। প্রত্যেকটি বিভাগেরই যেমন রয়েছে ভৌগোলিক সত্তা তেমনি ঐতিহাসিক সত্তা। যাহোক, বাংলার নদ-নদীর মধ্যে গঙ্গাই প্রধান। রাজমহলকে স্পর্শ করে গঙ্গা বাংলার সমতলভূমিতে প্রবেশ করেছে। সমতলভূমিতে প্রবেশ করেই গঙ্গার দুটি প্রধান প্রবাহ লক্ষ করা যায় একটি পূর্ব দক্ষিণগামী, নাম পদ্মা, অন্যটি মৌজা দক্ষিণমুখী নাম ভাগীরথী। গঙ্গার আরো অনেক শাখা প্রশাখা বাংলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলার নদীসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান প্রবাহ ব্রষ্মপুত্র, বাংলার উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসামের ভিতর দিয়ে গতিপথ কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমগামী এবং রংপুর ও কুচবিহারের সীমান্ত দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছে। বেশ কয়েকবার গতিপথ পরিবর্তন করে ব্রষ্মপুত্র বর্তমান যমুনা-পদ্মার পথে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীপ্রবাহ মেঘনা, এই নদী শিলং মালভূমি ও সিলেটের জলসম্ভার নিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। মেঘনার উত্তর প্রবাহের নাম সুরমা। আঞ্চলিক নদীসমূহের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে অজয় দামোদর, কাঁসাই, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ, সরস্বতী; আর উত্তরাঞ্চলে করতোয়া, আত্রাই, পূনর্ভবা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলো কোনো-না-কোনো নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোও ছিল নদীরই তীরে। এ মন্তব্যটির যথার্থতা বাংলার ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়। বাঙালির সমাজ জীবনের বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ধর্মীয় জীবনের স্বকীয়তা, এমনকি রাজনৈতিক জীবনের ওপরও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলি গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। অবস্থানগত কারণে বাংলায় অনার্য প্রভাব প্রাধান্যের বিষয়টি আজ প্রমাণিত সত্য। আর্য প্রবাহ পথ থেকে দূরে থাকায় বাংলার জীবন যাত্রার ওপর অনার্য সংস্কৃতি দৃঢ় হবার সুযোগ পেয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ভারত যতটা আর্যায়িত হয়েছে বাংলা ঠিক ততটা হয়নি। বাংলার 'ভৌগোলিক ব্যক্তিত্বে' তাই দেশজ উপাদান উপকরণের প্রভাব অনেক বেশি। প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতেও ভৌগোলিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এখানকার ধর্মীয় জীবনে 'মানবতা' ও 'উদারতা' প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের আগমন, বিস্তার, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, বৌদ্ধধর্মের বিকৃতিকরণ, হিন্দু ধর্মের সাথে আপোষ, মূর্তি পূজার প্রচলন, কিংবা পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, মাজার সংস্কৃতির প্রাধান্য, পীর, সুফিদের প্রতি ভক্তি ইত্যাদি ঘটনা বাংলার 'আঞ্চলিক ব্যক্তিত্বকেই তুলে ধরে। বাংলার শিল্পকলার ক্ষেত্রে স্বকীয়তা ও এ অঞ্চলের ভৌগোলিক উপাদানের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে। যেমন বাংলার বিশেষ ধরনের মাটি, পোড়ামাটির শিল্প, অলংকৃত ইট তৈরিতে সাহায্য করেছে যা প্রাচীন শিল্পকলায় অনন্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এছাড়া বাঁশের ব্যবহারও শিল্পকলায় স্বকীয়তা দান করেছে। প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙলার অর্থনৈতিক জীবনে ভূগোলের দান অপরিসীম। কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সবটুকুই ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশের ওপর ছিল নির্ভরশীল। বাংলার অবস্থান, মৌসুমী জলবায়ু, অসংখ্য নদ-নদী এ অঞ্চলকে উর্বর কৃষিক্ষেত্রে পরিণত করেছে। ধান, ইক্ষু, আম, ডালিম, কলা, গুবাক, কাঁঠাল ইত্যাদি এখানকার প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলি বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় থেকে এ অঞ্চলের ভূমিজাত দ্রব্য। নদী, বন্যা ও মৌসুমী জলবায়ু বিপুল ধান উৎপাদনে সহায়ক ছিল। তবে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রথমত, গাঠনিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভূ-খণ্ডের অস্তিত্ব বা অবস্থান উপমহাদেশের সর্বপূর্বান্তে নির্ধারিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ভূ-তাত্ত্বিকভাবে বাংলা সুগঠিত ভূ-ভাগ এবং অপেক্ষাকৃত নবীন ভূ-ভাগের সমন্বয়ে সৃষ্ট।

তৃতীয়ত, বাংলা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বা 'ডেল্টা’। 

চতুর্থত, বাংলা মৌসুমী জলবায়ুর দেশ, বৃষ্টিবহুল অঞ্চল।

পঞ্চমত, এর দক্ষিণে উন্মুক্ত সমুদ্রদ্বার এবং অঞ্চলটি নদী বহুল।

এ সকল বৈশিষ্ট্য বাংলার ইতিহাসে বহুমুখী প্রভাব বিস্তার করেছে। এই তিনটি বৈশিষ্ট্য বাঙালি চরিত্রে ‘আলস্য’ প্রবণতাও যুক্ত করেছে। ধান, কার্পাস, চিনি, লবণ ইত্যাদি শিল্প প্রাচীনকালে বিকশিত হয়। বাংলার বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া নৌ-শিল্পেও বাংলার অগ্রগতি ছিল দৃষ্টান্তমূলক। ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালি ভৌগোলিক সুবিধার সদ্ব্যবহার করেছে। নদ-নদী এবং উন্মুক্ত সমুদ্রদ্বারের কারণে বাংলা বৃহত্তর বাণিজ্য বলয়ের সঙ্গে সহজেই যুক্ত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাংলার ছিল গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এছাড়া আরবের বণিকেরাও এ অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রাজনৈতিক দিক থেকেও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলি বাংলাকে সুরক্ষিত করেছে। 

বাংলা নামের উৎপত্তি : সুপ্রাচীনকালে বাংলার ছিল কৌমভিত্তিক চেতনা, স্বতন্ত্র্য কিছু জনপদ, ঐক্য তখনও বাংলায় আসেনি; বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল, গৌড়সহ বিভিন্ন সময়ের বাংলার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। তবে 'বঙ্গ' নামটিই শেষ পর্যন্ত বৃহৎ আকারে 'বাঙ্গালা' নামে রূপান্তরিত হয়। অনেকে বঙ্গকে চীন তিব্বতী গোষ্ঠীর শব্দ এবং এ শব্দের ‘অং’ অংশের সঙ্গে গঙ্গা, হোয়াংহো, ইয়াংসিকিয়াং ইত্যাদি নদীর নামের সম্বন্ধ ধরে অনুমান করেন যে, শব্দটির মৌলিক অর্থ ‘জলাভূমি’ এবং ‘বঙ্গ’ নামের উদ্ভব হয়েছে বাংলার অসংখ্য নদ-নদী, বিল-হাওড়ের বাস্তব ভৌগোলিক অবস্থা থেকে। মধ্যযুগের ঐতিহাসিক আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বলেন, “বাঙ্গালার আদি নাম ছিল বঙ্গ। এখানকার রাজারা প্রাচীনকালে ১০ গজ উঁচু এবং ২০ গজ প্রশস্ত প্রকাণ্ড ‘আল’ নির্মাণ করতেন। এ থেকেই 'বাঙ্গাল' এবং 'বাঙ্গালাহ' নামের উৎপত্তি।” নদীমাতৃক, বারিবহুল এবং বন্যা ও জোয়ারের দেশে ছোটোবড়ো ‘আল’ বা ‘আইল’ বা 'বাঁধ' নির্মাণ করার যুক্তি একেবারে অগ্রহণযোগ্য নয়। ‘বাংলা’ নামের উৎপত্তির ইতিহাস খুঁজতে হলে সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের কথা বলতেই হবে। বস্তুত ইলিয়াস শাহ (১৩৫২ খ্রিঃ) প্রকৃত অর্থে ‘বাঙ্গালা’ নাম প্রদানের কৃতিত্বের অধিকারী। একই সাথে একথাও আজ ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ইলিয়াস শাহই বাংলার তিনটি শাসনকেন্দ্রের (লখনৌতি, সাতগাঁও, সোনারগাঁও) ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন এবং ‘লখনৌতির মুসলিম রাজ্যকে’ ‘বাঙ্গালার মুসলিম রাজ্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সম্ভবত এরপর থেকেই সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলের জন্য ‘বাঙ্গালা' নামটি ব্যবহৃত হতে থাকে। সমকালীন ভারতের ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফীফ ইলিয়াস শাহকে অভিহিত করেন 'শাহ-ই-বাঙালাহ' বা 'শাহ-ই-বাঙালীয়ান' আখ্যায়। ইলিয়াস শাহের সেনাবাহিনীকে বলা হয়েছে 'বাঙ্গালার পাইক'। বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে 'বাঙ্গালা' এবং এখানকার অধিবাসীদের 'বাঙ্গালি' নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে মুঘলদের আমলে বাংলা পরিচিত হয় 'সুবা বাঙ্গালা' হিসেবে। আরো পরে পর্তুগিজ, ইংরেজ এবং অন্যান্য ইউরোপীয়রা বাংলাকে ‘বেঙ্গালা’, 'বেঙ্গল' (Bengal) নামে অভিহিত করেছে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলা অঞ্চল সারা পৃথিবীতে 'বেঙ্গল' হিসেবেই পরিচিত ছিল।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র হিসেবে লিপিমালা এবং মুদ্রার গুরুত্ব নির্ণয় করুন?

উত্তর : ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উৎসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উৎস যত স্বচ্ছ, যৌক্তিক ও প্রায়োগিক হয় রচিত ইতিহাস ততই প্রাণবন্ত হয়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের পুনর্গঠনের কাজটি একটি জটিল বিষয়। কারণ বাংলার কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস প্রাচীনকালে রচিত হয়নি। যে সমস্ত সুত্রের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচিত হয় সেগুলোই ইতিহাসের উৎস। হয়েছে। মহাস্থান গড়ে কুশান রাজা কণিষ্কের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। পাহাড়পুরে ৩টি তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে। ময়নামতির শালবন বিহারে হরিকেল মুদ্রা' নামে অনেক মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে এছাড়া শ্রীবিগ্র নামে কয়েকটি মুদ্রা পাওয়া গেছে। প্রাচীন ইতিহাস রচনায় মুদ্রা যেমন রাজার সার্বভৌমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তেমনি রাজার মতামত শিল্পনিপুণতা, রাজ্যকাল, সময়কাল রাজার ব্যাপ্তী বিস্তার সম্পর্কে জানা যায়। মুদ্রায় অঙ্কিত রাজারা দেব-দেবীর প্রতিকৃতি (Portrait) থেকে সমাজের অভিজাত শ্রেণির রুচিবোধ, পোশাক পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলার ক্ষেত্রেও মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রশ্ন : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের পুনর্গঠনে স্থাপত্য ও চারু-কারু শিল্পের অবদান কতটুকু?

উত্তর : ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে লিপিমালা মুদ্রার মতো প্রাচীন স্থাপনা যার মধ্যে স্থাপত্য ও চারু-কারু শিল্পের অবদান অস্বীকার করা যায় না। বাংলার প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্ব যদিও সহজপ্রাপ্য নয় তথাপি স্থাপনা প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সভ্যতার একটি অন্যতম নিদর্শন যা ইতিহাস রচনার উপাদান রূপে বিবেচিত প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনা বা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে লিপিমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাচীনকালের মানুষ শিলাগাত্রে তামার পাত বা স্তম্ভের গায়ে লিপি উৎকীর্ণ করতেন। সাধারণত শিলাগাত্রে উৎকীর্ণ প্রাচীন বাংলায় ইট, পোড়ামাটির সিলেও লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সমস্ত লিপি থেকে যে সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয় তা হল সমসাময়িক রাজার নাম, পদবি, পরিচয়, পূর্ব পুরুষদের পরিচয়, গৌরবময় বাংলার বহুস্থানে প্রাচীনকালের স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব কাজের বিবরণ এবং উক্ত রাজাদের বংশের তালিকাও এইসব লিপিমালা থেকে উদ্ঘাটিত স্থাপনার মধ্যে দুর্গ, বিহার, মন্দির স্তূপ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন বাংলার দুর্গসমূহের মধ্যে হয়েছে। যেমন— বাংলার পাল, সেন, চন্দ্র ইত্যাদি রাজবংশের পূর্ণাঙ্গ তালিকা উদ্‌ঘাটন মহাস্থানগড়, বানগড়, চন্দ্রকেতুগড়-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুর্গনগরী হিসেবে করা সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, বাদল স্তম্ভ শিলালেখ, মহিপালের বানগড় এই সমস্ত স্থানগুলি চিহ্নিত হয়েছিল যা ছিল একসময় শিল্প বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্র। শিলালেখ, ভাগলপুর তাম্রশাসন প্রভৃতি। প্রাপ্ত অনেক লিপিতে সন, তারিখ উৎকীর্ণ প্রাচীন কালে মহাস্থানগড় পরিচিত ছিল পুণ্ড্রনগর হিসেবে এবং বানগড় পরিচিত ছিল দেখা যায়। প্রাচীন বাংলার প্রাপ্ত এধরনের সনগুলোর মধ্যে গুপ্তাব্দ, শকাব্দ প্রভৃতি দেখা কোটি বর্ষ হিসেবে। এই সমস্ত দুর্গ নগরগুলোর খননকার্য করে প্রাচীন কালের বাংলার বহু যায়। গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত ৩২০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। তার সাংস্কৃতিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্রনগর ছিল মৌর্য ও গুপ্ত যুগে সিংহাসন আরোহনের এই সময় থেকেই শকাব্দ গণনা শুরু হয়। এই সময় বিভিন্ন লিপি | বাংলার উত্তরাঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র। পাল রাজা ধর্মপালের অমর কীর্তি নওগা জেলার থেকে সম্রাজ্যের সম্প্রসারণ সম্পর্কে জানা যায়। রাজার ভূমিদান ও জমি ক্রয় বিক্রয়ের পাহাড়পুর অঞ্চলে সোমপুর বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। দলিল মূলত তামার ফলকে উৎকীর্ণ করা হত এবং এর থেকে সেসময় রাজাদের প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের পুনর্গঠনে চারুকারু শিল্পের অবদানও কম নয়। চারু দানশীলতারও পরিচয় পাওয়া যায়। এর থেকে জমির পরিমাণ, মূল্য ও আরও অন্যান্য অর্থ-মনোহর, যা মনকে হরণ করে। এক্ষেত্রে সুন্দর শোভন সুদর্শন কমনীয়। কারু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। এছাড়া তৎকালীন শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য অর্থ—শিল্প শিল্পকলা, নির্মাতা, কর্তা, শিল্পকর্ম ইত্যাদি। প্রাচীন বাংলায় চারু-কারু শিল্প সম্পর্কে এই শিলালেখ থেকে জানা যায়। হিসেবে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প ইত্যাদি নিদর্শন উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত নিদর্শনের ইংরেজি coin শব্দের পরিভাষা হচ্ছে মুদ্রা। Coin শব্দটি ল্যাটিন কিউনিয়াস মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি (Cuneus) এর হতে আগত। মুদ্রার সংখ্যা হিসেবে বলা যায় যে, স্বর্ণ, রৌপ্য বা এরূপ সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। প্রাচীন বাংলায় চারু ও কারু শিল্প সাধারণত উচ্চবৃত্ত শ্রেণীর লোক শিল্পকারদের দিয়ে কাজ করাতেন কারণ সে সময় চারু ও কারু শিল্প তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে অর্থব্যয় হত। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল ও সেন যুগে চারু ও কারু শিল্পের প্রচুর নিদর্শন বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গিয়েছে। সাধারণত এসব শিল্পের বেশিরভাগ নিদর্শনে বিভিন্ন প্রকার দেবদেবীর চিত্র অঙ্কিত আছে। এছাড়া প্রাচীন বাংলার নারীদের বিভিন্ন রূপ, তৎকালীন কৃষি ব্যবস্থার একটি সুস্পষ্ট দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বাংলার ইতিহাসে নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন চারু ও কারু শিল্প বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি এবং অতিসম্প্রতি ২০০১ খ্রিস্টাব্দে নরসিংদি জেলার ওয়ারি-বটেম্বরের খননকার্য এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের নিশ্চয়তা প্রমাণ করেছে। 

প্রশ্ন : বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উৎস সমূহের গুরুত্ব আলোচনা করুন?

উত্তর : আমরা সকলেই জানি যে ইতিহাস রচনা ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদান-এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন বাংলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল উৎসের মতো সাহিত্যেক উৎস পর্যাপ্ত নয়। এর অনেক কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে বাংলার ইতিহাসে রাজনৈতিক বিপ্লব এতটাই ঘন ঘন সম্পন্ন হয়েছে যে একটি বংশের ইতিহাস অন্য বংশের লোকেরা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন বোধ করত না। তবুও কিছু কিছু সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায় যেগুলোর সবকিছুই প্রায় ধর্মসংক্রান্ত পুস্তক। কিছু কিছু সাহিত্যিক উপাদানে প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের চিত্র পাওয়া যায়। সাহিত্যিক উপাদনগুলি দুটিভাগে ভাগ করা হয় যা হল দেশীয় সাহিত্য এবং বিদেশি সাহিত্য। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দেশীয় সাহিত্যিকদের প্রথমেই যেগুলির কথা উল্লেখ করতে হয় সেগুলি হল বেদ, গ্রিক, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থাদি। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় এ সমস্ত তথ্যবলি নিঃসন্দেহে অতি মূল্যবান। এ সমস্ত গ্রন্থের কাহিনি মূলত কিংবদন্তিমূলক। পরবর্তী উপাদান হিসেবে আসে জৈন ও বৌদ্ধ কাহিনির কথা। তিনটি দ্বীপবংশ, মহাবংশ এবং আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক বৌদ্ধসংক্রান্ত গল্পে বাংলার পাল রাজা ও সমাজ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে প্রাচীন বাংলার অনেক মূল্যবান তথ্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। পতঞ্জলি ও পাণিনি দু'জন ব্যক্তি ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণ রচয়িতা। তাদের রচিত ব্যাকরণগুলোতে প্রাচীন বাংলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্য প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার উৎস হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ভারতের মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত-এর প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার শ্বেতস্নিগ্ধ সুতিবস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তর ভারতের সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রিঃ)-এর মহাকবি ছিলেন বাণভট্ট। বাণভট্ট হর্ষচরিত নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে গৌড়রাজ শশাঙ্ক ও গৌড়ীয় সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ভারতের কাশ্মীরের ঐতিহাসিক তিনি 'রাজতরঙ্গিনী' নামক একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে মূলত কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত বিবৃত হয়েছে। গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে কাশ্মীর রাজার পৌত্র ‘গয়াপীড়’ গৌড় রাজ্য অধিকার করেন। এই সমস্ত তথ্য প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অসম্ভবভাবে সহয়তা করে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিত' গ্রন্থটি অনন্য সাধারণ একটি দলিল। কাব্য ছন্দে রচিত রামচরিত গ্রন্থটি মূলত দ্বিতীয় মহিপাল থেকে মদনপাল পর্যন্ত পালবংশ এবং কৈবর্ত রাজবংশের ইতিহাস রচনার জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। সন্ধাকর নন্দীর বাড়ি ছিল পৌণ্ড্রদেশে। তাকে কলিকালে বাল্মীকি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন একজন পাল রাজার পদস্থ রাজকর্মচারী। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছোটোবেলা থেকেই তিনি খুব কাছ থেকে রাজদরবারের ঘটনাবলি দেখে শুনে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় বিদেশি সাহিত্য তথা পর্যটকদের ভ্রমণ সংক্রান্ত বিবরণী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভারতবর্ষের বাইরে লেখকদের বিশেষ করে গ্রিক রোমান এবং চৈনিক বিবরণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিক লেখক টলেমি রচিত ভূগোলবিষয়ক গ্রন্থে ভারতবর্ষ ও বাংলার সমুদ্র সফরের বিবরণ রয়েছে। রোমান থেকে প্লিনি গঙ্গারডিহ রাজ্যের বিবরণ দিয়েছেন। চিনা পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়ান সাং-এর বর্ণনায় সমগ্র ভারত তথা বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস এমনকি প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। তিব্বতের সঙ্গে ভারতবর্ষের নিবিড়ভাবে সম্পর্ক ও বাংলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। লামা তারকনাথ তিব্বতি লেখকদের অন্যতম, যার রচনা থেকে প্রাচীন বাংলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি জানা যায়।

প্রশ্ন : প্রাচীন 'বঙ্গ' সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও?

উত্তর : 'বঙ্গ' একটি সুপ্রাচীন জনপদ। সর্বপ্রথম ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন যে বঙ্গজাতি থেকেই দেশটি নাম বা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সুকুমার সেন তাঁর মত প্রকাশ করেছেন যে- প্রাচীন ভারতের অধিকাংশ দেশের নাম জাতির নাম থেকে এসেছে। এই কারণে সংস্কৃতে দেশ নামে সাধারণত বহু বচনের ব্যবহার দেখা যায়। বঙ্গজাতি অধ্যুষিত জনপদ হল বঙ্গদেশ। অবশ্য শব্দটি চিনা তিব্বতীয় শব্দ এবং শব্দটির লৌকিক অর্থ জলাভূমি বলে কেও কেউ মনে করে থাকেন। যারা এই জলাভূমির দেশে পুরুষাক্রমিকভাবে বসবাস করতেন তারাই বঙ্গ এবং তাদের আবাস স্থল বঙ্গদেশ নামে অভিহিত হয়েছে। সে যাই হোক না কেন, এই বঙ্গ ছিল পূর্বাঞ্চলের দেশ। বৌধায়ন ধর্মসূত্র, পুরাণ, শিলালিপি হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন বঙ্গদেশের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। কবি কালিদাসের পদ্মা ও ভাগীরথী মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। এই বিশেষ ভূভাগই সম্ভবত টলেমির 'গঙ্গারিডাই'। রঘু কাপিশা নদী অতিক্রম করে কলিঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন, যা থেকে অনেকে অনুমান করেন যে বঙ্গের পশ্চিম সীমা তখন কাসাই নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু এই সম্পর্কে রঘুবংশ কাব্যগ্রন্থ প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ভাগীরথী থেকে কাঁসাই নদী পর্যন্ত ভূভাগকে সুন্দ অঞ্চল বলা হয়েছে। এবং রঘু এই সুন্দ থেকে বঙ্গ গায় এসেছিলেন। আবার শক্তিসভ্রমতন্ত্রের ‘ষটপক্যাশদেশ’ বিভাগ গ্রন্থে সমুদ্র থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অঞ্চলই এই নামে অভিহিত করা হয়েছে। যা থেকে অনুমান করা হয় যে ময়মনসিংহ জেলার অভ্যন্তরে প্রবাহিত ব্রষ্মপুত্র নদ-এর পূর্বসীমা নির্ধারণ করেছে। সম্ভবত সুন্দরবনের পূর্বপ্রান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহিত স্রোতধারার মধ্যবর্তী ভূভাগই ছিল ‘বঙ্গ”। সেন লিপিমালাতেও এই ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর থেকে অনেকে অনুমান করেন যে, ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল অঞ্চল বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গ জনপদের সীমা সম্পর্কে রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, সাধারণত পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে পদ্মা, পূর্বে ব্রষ্মপুত্র ও মেঘনা এবং দক্ষিণে সমুদ্র এর সীমারেখা ছিল। এছাড়াও বৃহৎ সংহিতা গ্রন্থে এই জনপদের উল্লেখ আছে। পাল শাসনের শেষের দিকে বনভূমি উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল নামে বিভক্ত হয়েছিল এবং পরবর্তী সেন লিপিমালায় বিক্রমপুর ভাগ ও নাব্যমণ্ডল নামে এটি অভিহিত হয়েছে। বিক্রমপুর এখনও সুপরিচিত এবং শতভাগে উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার বঙ্গের সঙ্গ সম্পর্কিত হরিকেল ও সমতট জনপদের উল্লেখ য়ুয়ান-চুয়াং-এর বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গল্পে এটি পৃথক পৃথক অঞ্চল বলে অভিহিত হয়েছে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*