রাম
মন্দির সংক্রান্ত তথ্য
সাম্প্রতিক খবরের শিরোনাম রামলালার মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা ২২ জানুয়ারি ভারতীয় ইতিহাস এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণের সাক্ষী রইল। দীর্ঘদিনের পর অবশেষে নিজের গৃহে পদার্পন করলেন রামলালা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যার নির্মীয়মাণ রামমন্দিরে ঘড়ি অনুযায়ী মোট ৮৪ সেকেন্ডের মাহেন্দ্রক্ষণে রামলালার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। উপস্থিত ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যপাল আনন্দিবেন প্যাটেল, প্রধান পুরোহিত মোহান্ত নিত্যগোপাল দাস এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। পাশাপাশি বিভিন্ন জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন।
—রাম
মন্দির সংক্রান্ত তথ্য–
এই রামমন্দির তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ২৫৮৭টি স্থানের পবিত্র মাটি। • মন্দিরের পবিত্রতা অনুষ্ঠানে দেশের ১৫০টি নদীর গুণাতল নিয়ে আসা হয়েছে অযোধ্যায়। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও মানস সরোবরের জল নিয়ে আসা হয়েছে।
• ৭১ একর জমির উপর মন্দির নির্মিত হয়েছে, মন্দিরের পরিধি ২৫০ ফুট এবং উচ্চতা ১৬১ ফুট। মন্দিরটি তিনতলা এবং পুরাতন নাগারা সংস্কৃতিতে নির্মিত হয়েছে। রাজস্থানের ভরতপুরের বানসি-পাহাড়পুর এবং মির্জাপুর থেকে নিয়ে আসা গোলাপি বেলেপাথরে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। মন্দিরটি এমন ভাবেই নির্মিত হয়েছে যাতে হাজার বছরেও মন্দিরের কোনো ক্ষতি হবে না। মন্দির নির্মাণে লোহা ব্যবহার করা হয়নি এমনকি মাটিতে কংক্রিটের ব্যবহার করা হয়নি। আর্দ্রতা থেকে মন্দিরকে রক্ষা করার জন্য বানানো হয়েছে ২১ ফুট গ্রানাইটের স্ল্যাব। মন্দির তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১৮০০ কোটি টাকা। • মূল মন্দিরের এলাকা ২.৬৭ একর এবং মন্দিরে রয়েছে ৩৯০টি স্তম্ভ, ৪৬টি দরজা এবং ৫টি মণ্ডপ। ৩৯০টি স্তম্ভে রয়েছে। ১৬-২৮ জন দেবতার মূর্তি। মূল গর্ভগৃহে রয়েছে রামলালার মূর্তি। এছাড়া মন্দিরে রয়েছে রঙ্গ মণ্ডপ, নৃত্য মণ্ডপ, সভা মণ্ডপ, প্রার্থনা মণ্ডপ ও কীর্তন মণ্ডপ। • মন্দিরের পূর্বদিকে ৩২টি সিঁড়ি পেরিয়ে দর্শনার্থীদের মন্দিরে ঢুকতে হবে। মাটি থেকে মন্দিরের সিংহদ্বার ১৬.১১ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। মন্দিরে রয়েছে ২৪০০ কেজির একটি ঘন্টা ও ৪০০ কেজির থালা। ভগবান রাম ত্রেতাযুগে জন্মগ্রহণ করেছিল তাই এই মন্দিরসহ অযোধ্যা নগরীকে সেই রূপে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। অযোধ্যায় প্রদর্শিত হয়েছে ৪৫ কেজি ওজনের রামায়ণ যা তিনটি কাঠের বাক্সে ভরা রয়েছে। এটির দাম প্রায় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলটির চারকোণে রয়েছে সূর্য দেবতা, মা ভগবতী, গণপতি ও শিবের মন্দির। এছাড়া উত্তর বাহুতে মা অন্নপূর্ণার মন্দির এবং দক্ষিণ বাহুতে রয়েছে হনুমানজির মন্দির।
মন্দির কমপ্লেক্সে নর্দমা শোধনাগার, জল শোধনাগার, অগ্নিনির্বাপনের জন্য জলের ব্যবস্থা এবং স্বতন্ত্র পাওয়ার স্টেশন তৈরী করা হয়েছে যাতে বাইরের সম্পদের উপর ভরসা না করতে হয়। ২৫০০০ পুণ্যার্থী থাকতে পারেন, এমন একটি পিলগ্রিম ফেসিলিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে পুণ্যার্থীরা মেডিক্যাল সহায়তা ও লকার সুবিধা পাবেন।
রামমন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথের নাম রাখা হয়েছে ধর্মপথ, পথের দুধারে রয়েছে রামায়ণের বিভিন্ন চিত্র।
রামমন্দির চত্বরে থাকবে মহর্ষি বাল্মীকি, মহর্ষি বশিষ্ঠ, মহর্ষি বিশ্বামিত্র, মহর্ষি অগস্ত্য প্রভৃতি ব্যক্তিদের নামে আলাদা মন্দির।
মন্দিরের গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকছে গর্ভগৃহ ও পাঁচটি মণ্ডপ। রাম দরবার হবে দোতলায় এবং তিনতলায় কী হবে তা এখনও জানা যায়নি। কাজের সূক্ষতা বজায় রাখতে প্রতিটা পিলারের কাজ করছেন ওডিশার একজন করে শিল্পী, অন্যদিকে মার্বেল ফ্লোরিং এবং দেওয়ালের কাজ করছেন রাজস্থানের কর্মীরা।
শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধি দল ঐতিহাসিক ‘অশোক বাটিকা' থেকে একটি পাথর দিয়ে গিয়েছেন, কথিত আছে এখানেই লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে বন্দি করে রেখেছিলেন।
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত নজরদারী ব্যবস্থা।
—রামলালা মূর্তির বৈশিষ্ট্য—
মাইসুরুর শিল্পী অরুণ যোগীরাজের পাশাপাশি একইসঙ্গে বেঙ্গালুরুর গণেশ ভাট এবং রাজস্থানের সত্য নারায়ণ পাণ্ডেকেও রামলালার মূর্তি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ট্রাস্টের ১৫ জন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের মধ্যে ১১ জনের ভোট পড়ে অরুণের পক্ষেই। পাথরের তৈরি বিগ্রহ। উচ্চতা ৫১ ইঞ্চির কিন্তু ওজনে প্রায় ২০০ কেজি! মূর্তি তৈরির জন্য শালগ্রাম শিলা পাঠিয়েছিল নেপাল। তা দিয়ে কিন্তু মূর্তি তৈরি করেননি অরুণ। কারণ, খোদাইয়ের সময় নাকি বারবার সেই পাথর ভেঙে যাচ্ছিল। পরে ঠিক হয় কৃষ্ণশিলায় তৈরি হবে মূর্তি। এই কৃষ্ণশিলাটি প্রায় ২.৫ বিলিয়ন বছরের পুরানো। কৃষ্ণশিলাটি ম্যাঙ্গালুরুর কারকালা শহর থেকে আনা হয়েছিল ১০ টন ওজনের, ৯.৫ ফুট লম্বা, ৬ ফুট চওড়া এবং প্রায় ৪ ফুট পুরু।
রামলালা মূর্তিটি ৪.২৪ ফুট লম্বা ও ৩ ফুট চওড়া। বিগ্রহের চালচিত্রে রয়েছে বিষ্ণুর দশাবতার। মূর্তির একদিকে রয়েছেন হনুমান ও অপর দিকে রয়েছেন গরুড়। রামলালার মূর্তির যে মুকুট রয়েছে তাতে সূর্য, শঙ্খ, স্বস্তিক, চক্র ও গদা রাখা হয়েছে।
রামলালার মুকুটের পাশে রয়েছে সূর্য, শঙ্খ, স্বস্তিক, চক্র ও গদা। বালক রামের বাঁ হাতে ধনুক, ডান হাতে তীর।
মুকুট : উত্তর ভারতীয় স্টাইলে তৈরি সোনার মুকুটে পান্না, চুনি ও হিরের কারুকাজ। মুকুটে রয়েছে সূর্যের প্রতীক ও মুক্তোর ঝালর। তিলক : হিরে ও রুবি দিয়ে তৈরি তিলক কপালের মাঝখানে। মাথার উপর সোনার ছাতা।
কুণ্ডল : ময়ূরের মোটিফে তৈরি কুণ্ডলেও হিরে, চুনি, পান্নার ছড়াছড়ি। কণ্ঠ : আধখানা চাঁদের আদলে তৈরি কণ্ঠহারে দামি পাথরে তোলা ফুলের কাজ। চুনির ঝালর। গলা থেকে নাভির উপর পর্যন্ত আর একটি পাঁচ লহরি কণ্ঠহার ঝুলছে রামলালার গলায়।
সজ্জা : লক্ষ্ণৌয়ের হরসহায়মল সিয়ামল জুয়েলার্স থেকে তৈরি গয়না ও দিল্লির ফ্যাশন ডিজাইনের মণীশ ত্রিপাঠীর তৈরি পোশাকে সেজেছেন শিশু রাম। বেনারসি সিল্কের হলুদ ধুতি ও লাল অঙ্গবস্ত্রের পাড়ে খাঁটি সোনার জরির কাজ।
তির-ধনুক : মূর্তির বাঁ হাতে সোনার ধনুক ও ডান হাতে সোনার তির। বৈজয়ন্তী বা বিজয়মালা : সোনা ও চুনি দিয়ে গড়া বিশাল মালায় সুদর্শন চক্র, শঙ্খ ও মঙ্গল কলসের প্রতীক। রয়েছে পদ্ম, চাঁপা, পারিজাত, কুন্দও তুলসির মোটিফ।
ভুজবন্ধ : রত্নখচিত কঙ্কণ ও মুদ্রিকায় সাজানো রামলালার দুই হাত। কাঞ্চী বা কোমরবন্ধ': কোমরে মণিমুক্তো খচিত কোমরবন্ধে ঝুলছে। মুক্তো ও'রুবি দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঘণ্টা।
কৌস্তভ মণি : বুকের মাঝে চুনি ও হিরের তৈরি কৌস্তভ মণি। পায়েল: শিশু রামলালার পায়ে সোনার পায়েল ও আঙুলের আংটিতেও হিরে ও চুনির ছড়াছড়ি। পায়ের নীচে সোনার পদ্ম ও সোনার মালা সাজানো ৷
খেলনা : শিশু রামের খেলার জন্য সামনে রাখা রুপোর তৈরি খেলনা রথ, লাট্টু, ঝুমঝুমি ও হরেক রকম পশু।
রামলালার সূর্যতিলক : রামমন্দিরের বিশেষত্ব হল ‘সূর্য তিলক’। মন্দির এমনভাবে তৈরি হয়েছে, প্রতি রামনবমীতে সূর্যের আলো এসে পড়বে রামলালার তিলকে, স্থায়ী হবে ৬ মিনিট। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সাপোর্টে গিয়ারবক্স এবং রিফ্লেকটিভ মিরর ব্যবহার হয়েছে। এর সাহায্যেই সূর্যের পথ ট্র্যাক করে আলো গর্ভগৃহে এসে পৌঁছবে।
- অযোধ্যা মামলা রায়ের প্রাক ঘটনাবলী- পৌরানিক মতে রামচন্দ্র ইক্ষ্বাকু বংশ বা রঘু বংশে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমানের অযোধ্যাতে।
পরবর্তীকালে অযোধ্যা নগরী বিভিন্ন হিন্দু রাজবংশের রাজধানীর মর্যাদা পায় এবং বিভিন্ন মন্দির ও ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যার
নিদর্শন আর্কেওলজিক্যাল সার্ভেতে বাবরি মসজিদ কাঠামো
খননকালে পাওয়া যায়।
১৫২৮-মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি মন্দিরের জায়গায় বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলেন।
১৮৮৫-ফৈজাবাদ জেলা আদালতে বাবরি মসজিদের বাইরে চাঁদোয়া টাঙানোর আবেদন ব্রিটিশ আদালতে নাকচ হয়ে যায়। ১৯৪৯-বিতর্কিত মূল গম্বুজের মধ্যে আনা হয় রাম লালার মূর্তি। ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৯০ - লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বে গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে রথযাত্রা শুরু হয়।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ - করসেবকরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১০ এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয়, বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে সমবণ্টন করেন তিন বিচারপতি ২-১ সহমতের ভিত্তিতে।
৯ মে, ২০১১- অযোধ্যা জমি বিতর্কে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট।
৬ অগাস্ট, ২০১৯ - সুপ্রিম কোর্ট জমি মামলায় দৈনিক ভিত্তিতে শুনানির কথা জানায় ।
১৬ অক্টোবর, ২০১৯ - টানা ৪০ দিন শুনানির পরে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শেষ হয়।
দীর্ঘ ৫০০ বছরের বিতর্কের অবসান ৯ নভেম্বর, ২০১৯ ঘটিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ৫ জন বিচারপতির (রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি এস এ বোবদে, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস এ নাজির) ডিভিশন বেঞ্চ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অযোধ্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
কারও আস্থা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে রায় না দিয়ে জমি আইনের উপর ভর করে এই রায় প্রদান করা হয়। বাবরি মসজিদ কোনো ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয়নি। পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের রিপোর্ট অনুযায়ী মসজিদের নীচে প্রাচীন কোনো কাঠামো ছিল তবে সেটাতে ইসলামি স্থাপত্য ছিল না। মসজিদের নীচের যে কাঠামোর সন্ধান মিলে ছিল তাতে মন্দিরের কাঠামোর নিদর্শন স্পষ্ট নয়। তবে প্রাচীন মিথ অনুযায়ী এটি রামের জন্মস্থান সে বিষয়ে সংশয় নেই।
বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমির পুরোটাই রামমন্দির তৈরির জন্য দেওয়া হয়। তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্টি বোর্ড বানিয়ে তারই তত্ত্বাবধানে মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব তুলে দিতে বলা হয় কেন্দ্রীয় সরকারকে।
সরকার অযোধ্যাতেই অন্য কোনো জায়গায় ৫ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেবে। সেই জমিতে ওয়াকফ বোর্ড মসজিদ তৈরি করে নেবে।
২০২০ সালে রামমন্দিরের ভূমিপুজো করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও সেইসঙ্গে শিলান্যাস করেন।
২২ জানুয়ারি, ২০২৪ সালে মোট ৮৪ সেকেন্ডের মহেন্দ্রক্ষণে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।